আলপনার সূচনাটা অনেক দিন আগের। আর্যরা এ দেশে আসার আগে যারা বাস করত, তখন থেকে শুরু। এখন পর্যন্ত তা বর্তমান। আগের দিনে সাধারণত মহিলারা বিয়েবাড়ির উঠোনে, গায়েহলুদের পিঁড়িতে বা বাসরঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকত, ফলে বাড়ির সৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে যেত। চালের গুঁড়োর পিটালির মধ্যে একটুকরো কাপড় চুবিয়ে নকশা করা হতো। এর সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগ করা হতো শুকনো পাতার গুঁড়ো, কাঠকয়লা ও পোড়ামাটি।
বিয়েবাড়িতে আলপনা
অতীতকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিয়েবাড়িতে আলপনা আঁকার রেওয়াজ একটা অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র আবীর কর্মকার জানান, বিয়েবাড়িতে আলপনা না আঁকলে যেন বাড়ি সাজানোর অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একেকটা বাড়ির ক্ষেত্রে সাধারণত একেক জায়গা খোলা থাকে, আর সেই ফাঁকা জায়গাগুলো ঢেকে দেওয়ার জন্য আলপনা আঁকা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ঘর বা ওই জায়গাটার সৌন্দর্য কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বিয়েবাড়িতে সাধারণত দেয়ালজুড়ে আলপনা আঁকা হয় না। বরং মেঝে, উঠোন ও সিঁড়িতে এমনকি বাড়িতে যদি কোনো সরু রাস্তা থাকে, সেটিতে আলপনা এঁকে রাঙিয়ে তোলা হয়।
কোথায় কেমন নকশা
ডিজাইনের ক্ষেত্রে ‘রঙ্গবলি’ ডিজাইনকে খুব বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রঙ্গবলি বলতে সাধারণত লতানো ফুল বা পাতার নকশাকে বোঝায়। তবে এ ধরনের নকশার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোর আকার অনেকটাই ছোট হয়। এ ছাড়া আরও কিছু ডিজাইনের মধ্যে ‘কাদম্বরী’ ও ‘তিলকমঞ্জরি’ ডিজাইনগুলো খুব সহজেই ভালো লাগে। যে কারণে নকশা করার ক্ষেত্রে এগুলোর প্রচলনও অনেক বেশি। আর বর্তমান সময়ে সবার পছন্দ বিমূর্ত সব আলপনা। এগুলোর অনেকটাই দুই পাশে সোজা একটা লাইন থাকে এবং ভেতরে থাকে নকশা। এগুলো থাকে বেশির ভাগই ছড়ানো-ছিটানো।
নকশার রকমফের
সাধারণত মেঝে ও উঠোনের মতো খোলা জায়গাগুলোয় বৃত্ত ধরনের নকশা ভালো দেখায়। তাই বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত করে নকশা তৈরি করা হয়। আবার একটু লম্বা ধরনের জায়গাগুলো, যেমন-ঘরের সামনে চিকন এবং খানিকটা লম্বা করিডোরের ক্ষেত্রে নকশা করতে চাইলে সেগুলোও লম্বা হবে। আজকাল বৃত্ত, চতুভুêজের মতো জ্যামিতিক ডিজাইনের পাশাপাশি লোকজ চিত্রগুলোকে তুলে আনা হচ্ছে। তাই বিয়েবাড়িতে নকশার মধ্যে পালকিতে করে বউ শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার দৃশ্য, সঙ্গে থাকে বিয়েবাড়ির প্রধান ফটক, আলতো মুখে বউ সেজে বসে থাকা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। এগুলো একটার পর একটা ধারাবাহিকভাবে বসানো থাকে।
একালে আলপনায় শান্তিনিকেতনি শৈলী দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এ শান্তিনিকেতনি শৈলীর আলপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিমূর্ত, আলংকারিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আলপনার ব্যবহার করা নকশাগুলোর মধ্যে সূর্য, ধানগাছ, পেঁচা, মই, লাঙল, লক্ষ্মীর পা, মাছ, নৌকা, পান, পদ্ম, শঙ্খলতা, সিঁদুর কৌটা প্রভৃতি।
রং যেমন নকশার
বিয়ে মানেই উজ্জ্বল সব রঙের সমারোহ। এমনটাই ধারণা, কিন্তু নকশার ক্ষেত্রে একটু হালকা ধরনের রংগুলো বেছে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সাদা, অফহোয়াইট, হালকা লেবু, হালকা লাল, হালকা কমলা, হালকা খয়েরি, ছাই, হালকা আকাশি, হালকা গোলাপি এই রং দিয়েই বেশি আলপনা আঁকা হয়।
আলপনা আঁকিয়েরা
ঢাকা শহরসহ অনেক এলাকায় আলপনা আঁকিয়ে রয়েছে, যারা সম্মানীর বিনিময়ে আলপনা এঁকে দেয় বিয়েবাড়িতে। এ ক্ষেত্রে সপ্তাহখানেক আগে থেকে তাদের জানাতে হবে। তারা এসে বাড়ি বা ঘরের কোন কোন জায়গায় আলপনা আঁকলে তা দৃষ্টিনন্দন হবে, এর একটা হিসাবনিকাশ করে নেয়। এ ক্ষেত্রে তাদের সম্মানী সর্বনি্ন ১০ হাজার থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বে হয়ে থাকে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৫, ২০০৮
Leave a Reply