প্রতিযোগিতা
প্রাণ-প্রথম আলো আচার প্রতিযোগিতা ২০০৮
মজার আচার নিয়ে চমৎকার আয়োজন
জিনাত রিপা
মাছে-ভাতে বাঙালি। তবে বাঙালি শুধু মাছে-ভাতেই নয়, নিজেদের খাদ্যরসিক হিসেবে প্রমাণ করতে পিছিয়ে থাকে না পোলাও, খিচুড়ি বা বিরিয়ানির নানা পর্ব থেকেও। সোনায় সোহাগা লাগলে যেমন তা পায় পূর্ণতা, তেমনি ডাল হোক বা ঝোল, বিরিয়ানি বা খিচুড়ি, আচার পেলে খাবারের রুচিও বেড়ে যায় বহু গুণ। আচার আলাদা করে মূল খাবার নয়। কোনো খাবারের সঙ্গে যোগ হওয়া উপসঙ্গ মাত্র। অথচ এই আচারই যদি হয় প্রতিযোগিতার মূল বিষয়বস্তু, তবে তা প্রচলিত স্রোতের ধারায় নতুনই বটে। প্রাণ আরএফএল গ্রুপ আর প্রথম আলো এই নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে বছর কয়েক আগে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে অনুষ্ঠিত হলো নবম প্রাণ-প্রথম আলো জাতীয় আচার প্রতিযোগিতা ২০০৮-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। প্রতিযোগিতার স্লোগান ‘আজকের নারী, এগিয়ে চলো···’।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা বিকেল সাড়ে তিনটায়। ঘড়ির কাঁটা তখনো তিনটার আশপাশে। কিন্তু মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ। নিচতলা ভরে ওপরতলার আসনগুলোও ভরে উঠছে। দেশের আনাচ-কানাচের প্রতিযোগীরা এসেছেন। কেউ কাউকে চেনেন না, তাই বলে বসে নেই কেউ। নিজেদের মধ্যে পরিচয়পর্ব সেরে নিচ্ছেন নিজ দায়িত্বেই। মঞ্চের পেছনে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দল নিয়ে সেরে নিচ্ছেন নাচের শেষ মুহূর্তের মহড়াটুকু। এরই মধ্যে মঞ্চের পাশের দুটি বড় পর্দায় ভেসে উঠল লাক্স সুন্দরী জয়া রায়ের মুখ। পর্দায় দেখানো হচ্ছে আচার প্রতিযোগিতার বিচারকার্যের নানা দৃশ্য। তারই উপস্থাপনা করছেন জয়া। অভিনয়শিল্পী দিতি, শর্মিলী আহমেদ, রিচি, সুইটি, বিন্দু, রান্নাবিদ সিতারা ফেরদৌস, কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলি এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষ ড· ফিরোজা সুলতানা ছিলেন মূল বিচারক। কারও টক খেয়ে অবস্থা খারাপ, তো কেউ ঝালের কবলে পড়ে ত্রাহি দশায়। এত কিছুর পরও সবাই সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করেছেন বিচারকাজ। মোট চারটি বিভাগে দেওয়া হয় পুরস্কার। টক, ঝাল, মিষ্টি ও অন্যান্য বিভাগে এবার আচারের নমুনা এসেছিল প্রায় চার হাজার ৫০০টির মতো। তার মধ্যে বিচারকদের নাকের পানি, চোখের পানি এক করে শেষ পর্যন্ত উঠে আসে ৪৮টি আচারের নমুনা। জয়া তথ্যগুলো দেওয়া শেষ করলে মঞ্চে উঠে আসেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল। ‘ধিতাং ধিতাং বোলে, কে মাদলে তাল তোলে···’-এর সঙ্গে মঞ্চ মাতালেন তাঁরা। এলেন ফিমা। প্রতিযোগিতার নবম আসরের কান্ডারি তিনি। প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক উজমা চৌধুরী সূচনা বক্তব্যে জানান, এবার প্রতিযোগিতার জন্য নমুনা চাওয়া হয়েছিল মার্চ-এপ্রিল মাসে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষে নভেম্বরে হচ্ছে মূল অনুষ্ঠান। তিনি ঘোষণা দেন, এ বছর চারটি বিভাগে যাঁরা প্রথম হবেন তাঁদের আচার নিয়ে ‘হোম মেইড পিকল’ নামে প্রাণ আচার আনবে বাজারে।
আচার ব্যাপারটির সঙ্গে কেবল নারী সম্পর্কিত-এ তথ্য এত দিন যাঁরা জেনে বা মেনে এসেছেন, তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণ করতেই অনুষ্ঠানস্থলে সমাগম হয়েছিল বিপুলসংখ্যক পুরুষেরও। নিজ পরিবারের সদস্যকে উৎসাহিত করতে বা নিজেই উৎসাহী হতে চলে এসেছেন। মঞ্চে আসেন কৃষ্ণকলি, যিনি শুধু গানই করেন না, গান সৃষ্টিও করেন। কালো শাড়িতে কৃষ্ণকলি গেয়ে যান দুটি গান। ‘ডুবি ডুবি ভেসে উঠি···’ এবং ‘যাও পাখি বলো তারে···।’ কৃষ্ণকলির সঙ্গে পুরো হলের আমন্ত্রিতদের মিলিত কণ্ঠ প্রমাণ করল গানগুলো সবার মন ছুঁয়েছে। এ আয়োজনের মিডিয়া সহযোগী চ্যানেল আই। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এমনিতেই মজা করে কথা বলেন। শ্রোতা মুগ্ধ হয় তার বাক্পটুতায়। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
একে একে মঞ্চে এলেন আট বিচারকের মধ্যে ছয়জন। জানালেন আচার চাখার অভিজ্ঞতা। শর্মিলী আহমেদ বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় পুরস্কার সবাই পায় না। তাই বলে অংশগ্রহণে পিছিয়ে পড়লে চলবে? প্রতিবার আচারের নমুনা জমা দিতে হবে এবং বিচারকদের রসনা মেটাতে হবে।’ উপস্থাপক ফিমা গান শুনতে চাইলেন দিতির কাছে। দিতি প্রথমে বললেন, তিনি একটি কনটেইনার না নিয়ে বিচারে এসে ভীষণ ভুল করেছেন। এরপর আর এ ভুল তিনি করবেন না। যাঁরা জানেন না, দিতি ভালো গাইতেও জানেন, তাদেরও মন মাতালেন তিনি ‘নিধুুয়া পাথারে···’ গানটি শুনিয়ে। রান্নাবিদ সিতারা ফেরদৌস যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের অভিনন্দন জানান। ড· ফিরোজা সুলতানা আচার তৈরির ব্যাপারে সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মানেন।
বিচারকেরা মঞ্চ থেকে নেমে আসনে গিয়ে বসলেন, এলেন বাপ্পা মজুমদার। তাঁর নতুন গান ‘সূর্যস্মান’ দিয়ে মাতালেন পুরো মিলনায়তন। এ পর্যায়ে মঞ্চে আসেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। নয় বছর ধরে প্রাণ আয়োজন করছে এ প্রতিযোগিতা। ২০০২ থেকে তার সঙ্গী প্রথম আলো। সঙ্গে পেয়েছেন সবার সাহায্য। ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানের সঙ্গে ফাহমিদা নবী মঞ্চে এলে কণ্ঠ মেলান সবাই। বাপ্পার গিটারের সঙ্গে ফাহমিদা গেয়ে শোনান, ‘মনটা তোমার হতো যদি একটা আবেগি নদী···’ গানটিও।
বাপ্পা গান শেষে শোনালেন মজার এক তথ্য। তিনি জানান শুরুতে ভাবছিলেন এ অনুষ্ঠানে তিনি কেন? চুরি করে খায়, এমন একটি খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতা হতে পারে তা ছিল তাঁর ভাবনার বাইরে।
দুবেলা আচার না হলে খেতে পারেন না-এমন একটি কারণই হতে পারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার প্রধান অতিথি হওয়ার যোগ্যতা; তা ছাড়া আর কোনো কারণ নেই বলে ভাবছেন বন্যা নিজেই। এখানে এসে কত ভালো লাগছে, জানাতে ভুললেন না তাও। অবশেষে শেষ হলো প্রতিযোগীদের অপেক্ষার পালা। বন্যার সঙ্গে মঞ্চে যোগ দিলেন প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লে· কর্নেল (অব·) মাহ্তাব উদ্দিন আহমেদ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব·) আমজাদ খান চৌধুরী, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর।
এবারের প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন টক বিভাগে যশোরের নিশাত সুলতানা; ঝাল বিভাগে বরিশালের লুৎফুন্নাহার; মিষ্টি বিভাগে যশোরের খাদিজা খাতুন লাবণী এবং অন্যান্য বিভাগে ধানমন্ডির রাজিয়া কাসেম। এঁরা প্রত্যেকে পাবেন ঢাকা-কাঠমান্ডু-ঢাকার দুটি করে এয়ার টিকিট। দ্বিতীয় পুরস্কারে টক বিভাগে ঢাকার মিরপুরের আয়শা জেসমিন; মিষ্টিতে চট্টগ্রামের মেহেরুন্নিসা তুলি; ঝালে ঢাকার মাহতাবুন নাহার রুবি এবং অন্যান্য বিভাগে সোবহানবাগ, ঢাকার বেগম নূরজাহান চৌধুরী-সবাই একটি ডিপ ফ্রিজ পাবেন। তৃতীয় স্থানে আছেন টকে ঢাকার প্রীতি রায়; মিষ্টিতে ঢাকার সাজেদা মনজুর; ঝালে চট্টগ্রামের রওশান আরা আমু এবং অন্যান্য বিভাগে ঢাকার রোকসানা পারভীন বেবী-সবাই পেয়েছেন একটি করে ডিনার সেট।
সেরা উপস্থাপনার জন্য মোবাইল ফোনসেট পেয়েছেন নারায়ণপুর, পাবনার ফয়জুন্নেসা লুনা। এ ছাড়া বর্ষসেরা আচার বিভাগে ঢাকা-মালয়েশিয়া-ঢাকার দুটি এয়ার টিকিটের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি জিতেছেন চান্দগাঁও, চট্টগ্রামের জোবাইদা আশরাফ।
খালি হাতে ফিরে যাননি কেউ। চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ ৪৮টি আচারের মধ্যে বকি ৩৪টি আচারের জন্য ছিল সান্ত্বনা পুরস্কার। আর যাঁরা পুরস্কার পাননি, তাঁরা অর্থাৎ অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক নারীই পেয়েছেন সনদপত্র।
মিলনমেলা ভাঙে প্রায় তিন ঘণ্টা পর; তবে বিরহের সুরে নয়, কোনো কিছু করে দেখানোর আনন্দে। পরিবারে এঁদের মর্যাদা ও স্থান আরও খানিকটা উঁচুতে উঠে যাওয়ার সাফল্যে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৫, ২০০৮
Leave a Reply