‘পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালবেসে
পউষের শেষরাতে আরো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে।’
ইউরোপ থেকে আসা এন্টিরিনাম, দক্ষিণ আফ্রিকার ডেইজি, ফ্রান্সের মেরিগোল্ড, মেক্সিকোর ডালিয়া-ন্যাস্টারশিয়াম, চীনের অ্যাস্টার, জাপানের চন্দ্রমল্লিকা, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লার্কিয়া-পপি, ফ্রান্স থেকে আসা কারনেশন-প্যানজি, সিসিলির সুইটপি, আমেরিকার লুপিন প্রভৃতি রূপসীরা এখন আমাদের দেশে। পৌষ-মাঘের শীতের ভোরে মসলিনের মতো পাতলা ফিনফিনে কুয়াশার পর্দা কাটতেই চোখের সামনে এসে একের পর এক হাজির হয় শিশিরভেজা বিদেশি এই সুন্দরীরা। ওদের একেকজনের মুখ দেখে কবি জীবনানন্দের মতো ওদের কেউ ভালো না বেসে কখনো থাকতে পারে? শীত এলেই বিদেশি নামের এসব সুন্দর ফুল আমাদের বাড়িতে, বাগানে ওদের রূপের পসরা সাজিয়ে বসে। ওদের রূপের আলোয় বাড়ির আঙিনা, নগর উদ্যান কিংবা প্রতিষ্ঠানের বাগানগুলো অপূর্ব হয়ে ওঠে। আমরা মুগ্ধ হই। সত্যিকথা বলতে কি, গ্রী্ন-বর্ষার কিছু মৌসুমি ফুলের জন্ম এই ভারতীয় উপমহাদেশে হলেও শীতের ফুল বোধ হয় একটিও নেই যার জন্ম এই উপমহাদেশে। বেশির ভাগই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। তাই ওই সব দেশের শীত কনকনে আবহাওয়াতেই ওরা সুখী থাকে। আমাদের দেশে বৃষ্টির জল আর গরম ওদের বাঁচতে দেয় না। কিন্তু তাই বলে ওদের রূপ এ দেশের মানুষ দেখবে না, তা তো হয় না। তাই যুগে যুগে বিদেশ বিভুঁই থেকে এ দেশের ফুলরসিক মানুষেরা এই রূপসীদের আমাদের দেশে ডেকে নিয়ে এসেছেন, শীতকালে আদর করে আমাদের দেশের মাটিতে ঠাঁই দিয়েছেন। আর ওরাও আদর-যত্ন পেয়ে যেন নিজেদের রূপ উজাড় করে মেলে ধরেছে। হরেক রকমের অজস্র ফুলে ভরে উঠেছে শৌখিন মানুষদের বাগান আর বাড়ির আঙিনা। তাই শিশিরভেজা শীতের ফুলের মধ্য দিয়ে পল্লীবাংলার রস আর পিঠার শীতে এসেছে এক অন্য রকমের পাশ্চাত্য আমেজ। এ শীতেও তার ব্যতিক্রম কেন হবে? এবারও শীতের ফুলগুলোকে আপনি কাছে টেনে নিন, যত্ন করে সেসব গাছে ফুল ফোটান-দেখবেন, প্রতিটি শীতের সকাল আপনার কাছে এক অন্য রকম আনন্দ নিয়ে ধরা দিচ্ছে। তাই আর দেরি নয়, এখনই চলুন বেরিয়ে পড়ি শীতের দারুণ সব ফুলের খোঁজে।
শীতের ফুলকে আঙিনায় লাগাতে গেলে স্বল্প সময়ে ফুটে শেষ হয়ে যায় এমন ফুল যেমন আছে, তেমনি একই গাছে অনেক দিন ধরে ফোটে এমন ফুলও আছে। বেশি দিন ধরে ফোটে ও থাকে চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা। স্বল্প সময়ে ফুরিয়ে যায় ন্যাস্টারশিয়াম আর পপি। কোথায় কী লাগাবেন সে ভাবনাটা আপনাকেই ভাবতে হবে। তবে তিনটি ফুল শীতে লাগানোর জন্য প্রথমেই বেছে নিতে পারেন। সেসব ফুলের বাহার দেখে চেনা-জানা লোকেরাও আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতে পারে। প্রথমেই লাগানোর জন্য বেছে নিতে পারেন গাঁদাকে। হলুদ গাঁদা দিয়েই শুরু করতে পারেন শীতের ফুলের বাগান করা। তিন ধরনের গাঁদা পাবেন। ইয়া বড় বড় আকারের যে গাঁদা, সেটা হাইব্রিড ইনকা গাঁদা। হলুদ, কমলা, ফিকে হলুদ ইত্যাদি রঙের ফুল ফোটা ইনকা গাঁদার চারা এখন প্রায় সব নার্সারিতেই ঠাসা। বেশি গাছ লাগাতে চাইলে ছোট চারা কিনবেন, দু-একটা হলে টবে লাগাবেন। একটু বড় গাছ কিনে বাড়ির বারান্দা, ব্যালকনি, ছাদ বা সিঁড়ির করিডরে রেখে যত্ন নেবেন। টবের না ফোটা কুঁড়িগুলো আপনার হাতের যত্ন পেয়ে কয়েক দিন পরেই ফুটে উঠবে। ছোট লাল রঙের প্রচুর ফুল ফোটা চীনা গাঁদা বা দেশি রাজগাঁদা লাগাতে পারেন বাড়ির সামনের বাগানে। এরপর অবশ্যই কয়েকটি চন্দ্রমল্লিকা আর ডালিয়া নেবেন। বাড়ি বা বাগানের প্রবেশপথের দুই ধারে ঝোপ করে চীনা গাঁদা, লুপিন, ডেইজি, অ্যাস্টার, ক্যালেন্ডুলা, কারনেশন, সুইটপি, প্যানজি প্রভৃতি লাগাতে পারেন। বাগানের মাঝে মাঝে কেয়ারি করে গাঁদাতেও এসব গাছ দেওয়া যায়-অ্যাস্টার, ডেইজি, কসমস, সিলভিয়া, চিংড়ি ফুল, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশন, পপি, সূর্যমুখী, ক্যালেন্ডুলা, সুইটপি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস প্রভৃতি। বারান্দা বা গ্রিলে ঝোলানো টবে লাগানোর জন্য ন্যাস্টারশিয়াম, স্টার, ভারবেনা প্রভৃতি উত্তম। ঝুলন্ত টবে লতিয়ে ফুল ফোটাতে চাইলে নিতে পারেন ন্যাস্টারশিয়ামকে। গ্রিলে লতিয়ে দেওয়ার জন্য নীলমণি লতা, সুইটপি ভালো। টবের জন্য নিতে পারেন গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, পপি, অ্যাস্টার, ক্যালেন্ডুলা প্রভৃতি। জমিনের বাগানে তো সব ফুলই লাগাতে পারেন।
শীতে ভালো ফুল ফোটানোর কিছু টিপস
–গাছ লাগানোর জন্য রোদ পড়ে এমন জায়গা বেছে নিন।
–গাছে পানি দেওয়ার সময় শুধু গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে ঝাঁঝরি দিয়ে গাছের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো গাছ ও পাতা ভিজিয়ে নিয়মিত হালকা পানি দিন। এতে গাছ বেশি সতেজ হবে।
–গাছের চেহারা দুর্বল দেখা গেলে পর পর তিন-চার দিন এক ঝাঁঝরি পানির মধ্যে দুই চা চামচ ইউরিয়া সার গুলে ওপরের নিয়মে সেচ দিন।
–জৈব সার কয়েক দিন পর পর অল্প অল্প করে গাছের গোড়ার চারদিকে দিন ও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। অন্তত কুঁড়ি না আসা পর্যন্ত দিন।
–ফুল ফোটা শুরু হলে তখন থেকে ফুল-পাতা ভিজিয়ে পানি না দেওয়া ভালো।
–গাঁদা ফুলের আকার বড় করতে চাইলে প্রথম কুঁড়িগুলো নখ দিয়ে খুঁটে ভেঙে দিন।
–স্বাভাবিক সময়ের আগে গাছে কুঁড়ি এলে তা ভেঙে দিন।
–গাছের গোড়া ভেজা থাকলে পানি দেবেন না।
–প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটি হালকা নিড়িয়ে বা খুঁচে দিন।
–ফুল শুকাতে শুরু করলে দ্রুত তা গাছ থেকে কেটে ফেলুন।
–প্যানজি গাছের বয়স হলে ফুল ছোট হয়ে আসবে। এ অবস্থায় গোড়া থেকে ছেঁটে দিলে নতুন গজানো ডালে আবার ভালো ফুল ফুটবে।
–এন্টিরিনামের ভালো ফুল পেতে হলে শুধু মাঝের ডালটি রেখে অন্য সব ডাল কচি অবস্থায় ছেঁটে দেবেন।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৮, ২০০৮
Bangla Lifestyle
Hi, this is a comment.