শোঁ শোঁ শব্দ কানের বা শরীরের অন্য কোনো রোগের উপসর্গ, যা রোগী তার কানে অনুভব করে। বাইরের কোনো শব্দ ছাড়াই নিজের কানে অস্বাভাবিক শব্দ শোনার অসুখটির নাম ‘টিনিটাস’।
শব্দটি নানা রকম হতে পারে। যেমন বাঁশির, ঘণ্টার, বাতাস প্রবাহের, গুনগুন-শোঁ শোঁ শব্দ ইত্যাদি। এ ধরনের শব্দ সাধারণত এক কানে অনুভূত হয়, তবে দুই কানেও হতে পারে।
টিনিটাস তিন ধরনের।
সাবজেকটিভ
বাইরের কোনো কোলাহল ছাড়া রোগী যখন কোনো অর্থহীন শব্দ শুনতে পায়। এ ক্ষেত্রে শব্দটির তীব্রতা নানা রকম হতে পারে। কেউ জোরে শোনেন, কেউ আস্তে। কেউ কেউ ২৪ ঘণ্টা একটানা শব্দ শোনেন। কেউ কেউ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর। এটি রোগীর ঘুমে অসুবিধা করে এবং রোগী মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারে না।
অবজেকটিভ
এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ, যেটা রোগীর নিজের শরীর থেকেই উৎপত্তি হয় বলে মনে করা হয়। যেমন-বাতাস প্রবাহের মতো শব্দ, ঘূর্ণায়মান রক্তের প্রবাহ, মাথার মাংসপেশির সংকোচন, কানের ভেতর মাংসপেশির সংকোচন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকও স্টেথোস্কোপের সাহায্যে শুনতে পান।
অডিটরি হ্যালুসিনেশন
অনেক সময় রোগী নির্দিষ্ট সময় পরপর কথা বা কোলাহল শুনতে পায়। যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকে এ ধরণের শব্দ উৎপন্ন হয় যা রোগী ভাবে সে শুনছে। এটি মানসিক রোগে (যেমন-সিজোফ্রেনিয়া) বেশি হয়। কানের কিছু অপারেশন, যেমন টিমপেনোপ্লাস্টি, টিমপেনোটোমিতেও টিনিটাস হতে পারে।
টিনিটাসের কারণ
- টিনিটাসের বড় কারণ বয়সজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া। তবে উচ্চশব্দের মধ্যে বসবাসকারী যে কারো এটি হতে পারে। আরো কিছু সাধারণ কারণের মধ্যে আছে-
- কানের মধ্যে খৈল বা ময়লা জমা
- কিছু ওষুধ সেবন যেমন-অ্যাসপিরিন ও অ্যান্টিবায়োটিক
- ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন-কফি, পান
- কানে ইনফেকশন বা কানের পর্দা ফেটে যাওয়া
- দাঁত ও চোয়ালের জয়েন্টে সমস্যা
- কানে আঘাত পাওয়া বা আকস্মিকভাবে জোরে বাতাস প্রবেশ করা
- ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশন থেরাপির প্রয়োগ
- মারাত্মক অপুষ্টিজনিত বা অনিয়ন্ত্রিত ডায়েটিংয়ের মাধ্যমে হঠাৎ বেশি ওজন হ্রাস পেলে
- রক্তনালির কিছু সমস্যা, যেমন- ক্যারোটিড অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হলে
- উচ্চ রক্তচাপ
- নার্ভের কিছু সমস্যা, যেমন-মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস হলে
- মাইগ্রেন
- কানে পানি গেলে
- শারীরিক অন্যান্য কিছু অসুখ, যেমন-অ্যাকুয়াস্টিক নিউরোমা, রক্তশূন্যতা, ল্যাবিরিন্থিস, মিনিয়ার্স ডিজিজ, অস্টিওস্ক্লেরোসিস, থাইরয়েডজনিত অসুখ ইত্যাদি।
ঘরের চিকিৎসা
- ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন কফি এড়িয়ে চলুন
- অ্যালকোহল পান করবেন না
- ধূমপান করবেন না। কারণ নিকোটিন কানের ভেতরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালি সরু করে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়। এতে টিনিটাসের প্রকোপ বাড়ে।
- অ্যাসপিরিন ও ব্যথানাশক যথাসম্ভব কম সেবন করবেন
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন। ব্যায়ামে রক্তনালিতে রক্ত প্রবাহ বাড়ে। এতে টিনিটাসের প্রকোপ কমে। তবে সাইকেল চালানোর মতো ব্যায়াম এ সময় না করা ভালো।
- উচ্চ শব্দ এড়িয়ে চলুন। কানে হেডফোন লাগাবেন না। বরং কান তুলা বা এয়ার প্লাগ দিয়ে বন্ধ রাখুন।
- কারো কারো ক্ষেত্রে ঘরে মৃদুস্বরে গান বাজালে টিনিটাস কম হতে দেখা যায়।
কখন ডাক্তার দেখাবেন
- যদি শরীরের কোনো অংশে অবশ অবশ লাগে বা ঝিমঝিম করে
- কানে শুনতে অসুবিধা হলে বা কানে না শুনতে পেলে
- ভার্টিগো বা মাথাঘোরার সমস্যা হলে
- এক সপ্তাহের বেশি সময় টিনিটাস থাকলে
- শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা হলে
- বমি হলে
- ঘন ঘন কানে শোঁ শোঁ বা টিনিটাস হলে
টিনিটাস থেকে বাঁচতে
- উচ্চ শব্দযুক্ত পরিবেশে কাজ বা বসবাস করা যাবে না। সেটা সম্ভব না হলে এ রকম পরিস্থিতিতে শব্দ কম শুনতে এয়ার প্লাগ
- ব্যবহার করতে হবে।
- কাত হয়ে কানের নিচে হাত রেখে ঘুমানো যাবে না।
- হেডফোনে যা-ই শুনুন, উচ্চৈঃস্বরে শুনবেন না।
- মুটিয়ে যাওয়া মানুষের টিনিটাস বেশি হয়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- কটন বাড বা এ ধরনের কোনো কিছু দিয়ে কান চুলকাবেন না। এতে কানের পর্দা ফেটে গিয়ে কানে শোঁ শোঁ শব্দ হতে পারে।
- কানে ময়লা জমলে তা বের করতে কাঠি ব্যবহার না করে অলিভ অয়েল দিন। এতে কানের ময়লাও বের হবে, পর্দাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
Leave a Reply