বাড়িতে বসে রক্তচাপ জানুন
ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন লিগের উদ্যোগে ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১৭ মে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য হলো উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘বাড়িতে বসে আপনার রক্তচাপ জানুন’।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন লোক উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত! অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন প্রাপ্তবয়স্কের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এটি হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) ও কিডনি সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ৫০ শতাংশ হৃদরোগের কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। সারা বিশ্বে ৭ দশমিক ১ মিলিয়ন লোক মারা যায় উচ্চ রক্তচাপের জন্য।
উচ্চ রক্তচাপ একটি লক্ষণবিহীন রোগ। ফলে অনেকে নিজের অজান্তেই এ রোগ নিয়ে বেঁচে আছেন। শুধু দিবস পালনই নয়, সব সময়ের সচেতনতা এই নীরব ঘাতক থেকে আমাদের রক্ষা করবে। কীভাবে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করা যায়; কীভাবে এর চিকিৎসা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা যায়-সে বিষয়ে জানাটা জরুরি।
বাড়িতে বসে আপনার রক্তচাপ জানার মাধ্যমে জীবনধারার পরিবর্তন, উপযুক্ত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে কীভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। সচেতন হোন, নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন। উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে পারলে হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, কিডনির সমস্যাও অনেকটাই প্রতিরোধ করা যাবে।
উচ্চ রক্তচাপ কী
একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ১২০-এর নিচে সংকোচন চাপ ও ৮০-এর নিচে প্রসারণ চাপ স্বাভাবিক মাত্রা নির্দেশ করে।
শরীরের রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০ অথবা এর বেশি হয়, তাহলে সেটাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের রক্তচাপ যদি সার্বক্ষণিক ১৪০/৯০-এর বেশি থাকে, তাহলে তার উচ্চ রক্তচাপ আছে বলে ধরে নিতে হবে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ কিছুটা বাড়তে পারে। উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা না করলে আমাদের গড় আয়ু কমতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক লোকের রক্তচাপ বছরে অন্তত একবার মাপা উচিত।
লক্ষণ
দেখা গেছে অধিকাংশ লোকই তাঁদের যে উচ্চ রক্তচাপ আছে তা জানেন না। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। যাঁদের উপসর্গ থাকে, তাঁদের সাধারণত মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখে ঝাপসা দেখা, বুক ধড়ফড় করা, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ হয়ে থাকে। কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ধরনের উপসর্গও হতে পারে। রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপা হলে এটি (যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে) ধরা পড়ে যায়।
রক্তচাপ মাপার নিয়ম
রক্তচাপ মাপার আগে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিতে হবে।
রক্তচাপ মাপার ৩০ মিনিট আগে থেকে ধূমপান, চা ও কফি পান করা যাবে না।
মাটিতে পা সমতলে রেখে, মেরুদণ্ড সোজা করে হাত হৃৎপিণ্ডের লেবেলে রেখে বসতে হবে। সঠিক মাপের বাহুবন্ধনী ব্যবহার করতে হবে। রক্তচাপ মাপার যন্ত্রটি সঠিক হতে হবে।
অন্তত দুই মিনিট ব্যবধানে একাধিকবার রিডিং নিতে হবে। রক্তচাপ মাপনযন্ত্রের বা স্কিগমোম্যানোমিটারের সাহায্যে রক্তচাপ মাপা হয়। এটি বন্ধনী, প্রসারক ও নির্দেশক যন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। আর সহায়ক হিসেবে থাকে স্টেথোস্কোপ।
বন্ধনীটি বাহুতে জড়িয়ে প্রসারকের সাহায্যে এ রকম চাপ প্রয়োগ করা হয়, যেন হাতের প্রধান ধমনি দিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ থাকে। প্রসারকের চাবি ঢিলা করে দিয়ে ধীরে ধীরে বন্ধনী থেকে বাতাস বের করে দেওয়া হয়। রক্ত চলাচল পুনরায় শুরু হলে স্টেথোস্কোপে স্পন্দন শোনা যায়।
নির্দেশক যন্ত্র এ সময় সংকোচন চাপ নির্দেশ করে। এরপর স্পন্দন ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। নির্দেশক যন্ত্র তখন প্রসারণ চাপ নির্দেশ করে।
উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা
উচ্চ রক্তচাপের নিয়মিত চিকিৎসা না করলে বা দীর্ঘদিন অনিয়মিত থাকলে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
হৃৎপিণ্ড
উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এটি হলে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি পুরু হয়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের আকার বড় হয়ে যায়। হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
কিডনির জটিলতা
কিডনি ফেইলিউর হতে পারে অথবা কিডনি কার্যকরভাবে শরীরের বর্জ্য অপসারণের ক্ষমতা হারাতে পারে।
মস্তিষ্কের জটিলতা
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে শরীরের অংশবিশেষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।
চোখের জটিলতা
উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখের রক্তনালির ওপর ক্রমাগত চাপ পড়ায় জটিলতা দেখা দিয়ে অন্ধত্বের সৃষ্টি হতে পারে।
চিকিৎসা
চিকিৎসায় উচ্চ রক্তচাপ ভালো হয় না। তবে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলেই সমস্যা। একদিন হয়তো এর কারণ জানা যাবে এবং তা নিরাময়ের আরও উন্নত চিকিৎসা বের হবে। প্রয়োজনীয় মাত্রায় নিয়মিত ওষুধ খেয়ে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওষুধ সারা জীবনই খেয়ে যেতে হয়। ওষুধ খেয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক হলে অনেকে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। মনে রাখবেন, ওষুধ না খেলে রক্তচাপ আবার বেড়ে যাবে এবং এতে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দুশ্চিন্তাহীন জীবন যাপন করতে হবে।
আজীবনই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। সুস্থ বোধ করলেই চিকিৎসা বাদ দেবেন না। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করুন। প্রতিদিন সময়মতো ওষুধ খাবেন। কোনো লক্ষণ নেই ভেবে ওষুধ খাওয়া বন্ধ রাখবেন না। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করাবেন। কোনো রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পরিবারের কোনো সদস্য উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে তাকে অভয় দিন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করুন।
উচ্চ রক্তচাপ কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
কম লবণযুক্ত খাবার খান, ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিন। চর্বিজাতীয় খাবার খাবেন না। দুশ্চিন্তা করবেন না। নিয়মিত হাঁটুন, হালকা ব্যায়াম করুন। ফলমূল ও শাকসবজি নিয়মিত খান। খাবার খান পরিমিত। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। পরিমিত বিশ্রাম নিন।
————————–
ডা. মো. শফিকুর রহমান পাটওয়ারী
মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
প্রথম আলো, ২১ মে ২০০৮
Leave a Reply