‘আপনি কি নম্বর ১২’
‘আমি কি নম্বর ১২’-এই অভিযান ইতিমধ্যে ৫৫টি দেশে সাড়া জাগিয়েছে। উঁচুদরের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে সিডনি থেকে সার্বিয়া, বেইজিং থেকে বুয়েনস এইরেস। বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের সভাপতি চার্লস গোর বলেছেন, “
;যেখানে ক্রনিক হেপাটাইটিসে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১৫ লাখ মানুষ, একে তো অবহেলা করা চলে না। ‘আমি কি নম্বর ১২’ অভিযানের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে ১৯ মে আমরা হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’-কে বিশ্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা এজেন্ডার মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ রোগে প্রতিবছর ১.৫ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
এইচআইভি বা এইডস রোগের চেয়ে ১০ গুণ বেশি সংক্রামক হলো হেপাটাইটিস ‘সি’ এবং ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক হেপাটাইটিস ‘বি’।
চিকিৎসা না হলে হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ রোগীদের ক্রমে ক্রমে হতে পারে সিরোসিস, পরিণতিতে যকৃতের ক্যান্সার, নিষ্ত্র্নিয় হতে পারে যকৃৎ এবং পরে মৃত্যু। কিন্তু এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা একত্রে এ কাজটি করতে পারি, সবাই মিলে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসকে সমর্থন জানাতে পারি। এ উদ্যোগে সক্রিয় সাড়া দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি।
এখনই উদ্যোগী হওয়ার সময়
আজকের এ উদ্যোগের পেছনে একটি ইতিহাস আছে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও চীনের হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা ২০০৭ সালের এপ্রিলে বার্সেলোনায় মিলিত হয়ে বিশ্বজোড়া উদ্যোগের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হলো। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস তাই তাৎপর্যপূর্ণ। এটি হেপাটাইটিস রোগীদের পরিচালিত একটি উদ্যোগ। এরই অনুবর্তীক্রমে জেনেভায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’।
তাই এ বছর ১৯ মে পালিত হলো প্রথম বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’র গুরুত্ব এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার চেয়ে কম নয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মিলেনিয়াম লক্ষ্যের মধ্যে যেসব রোগ রয়েছে, তার সঙ্গে হেপাটাইটিসও যোগ হওয়া উচিত।
এ উদ্যোগের ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ লিভার ফাউন্ডেশন এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে। বারডেমের হেপাটো বিলিয়ারি সার্জারির অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জানালেন সে কথা। এ উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছেন দেশবরেণ্য সব লিভার বিশেষজ্ঞ-অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক মবিন খান, অধ্যাপক এ কিউ এম মোহসেন, অধ্যাপক আনিসুর রহমানসহ অনেকে।
যকৃৎ ও হেপাটাইটিস সম্পর্কে কিছু কথা
দেহের ভেতর সবচেয়ে বড় যন্ত্র হলো লিভার বা যকৃৎ। পেটের ডান দিকে পাঁজরগুলোর পেছনে থাকা এ যন্ত্রের ওজন হলো ১.২ থেকে ১.৫ কিলোগ্রাম। কত এর কাজ! দেহের বিপাক কাজের কারখানা হলো যকৃৎ। রক্তকে বিষমুক্ত করা, হরমোন ও লোহিত কণিকাকে (পুরোনো) ভেঙে ফেলা; শর্করা, চর্বি ও প্রোটিনের বিপাক; পিত্ত নিঃসৃত করা; ভিটামিন, খনিজ ও লৌহ সঞ্চয়-এ রকম অনেক কাজের কাজি হলো যকৃৎ। অথচ যকৃৎ পুনর্জনন হতে পারে, নতুন যকৃৎ টিস্যু গড়ে উঠতে পারে। তাই এর বড় অংশ নষ্ট হলেও যকৃৎ কর্মক্ষম থাকতে পারে।
হেপাটাইটিস মানে যকৃতের প্রদাহ। এর কারণ হিসেবে রয়েছে ভাইরাস, অ্যালকোহল, ওষুধ, অন্যান্য বিষ। মাঝেমধ্যে দেহের প্রতিরোধের ব্যবস্থা নষ্ট হলেও যকৃতের প্রদাহ হতে পারে। পাঁচটি ভাইরাস হেপাটাইটিস ঘটাতে পারে। হেপাটাইটিস ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ ও ‘ই’। এর প্রতিটি ভাইরাস একই রকমের উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিটিই যকৃতের সংক্রমণ ও প্রদাহ ঘটাতে পারে। এদের মধ্যে পার্থক্য হলো কীভাবে এদের সংক্রমণ ঘটে, মানবদেহে এরা কীভাবেই বা প্রভাব ফেলে।
আরও দুটো ভাইরাস হেপাটাইটিস ‘এফ’ ও ‘জি’ সম্পর্কে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। তবে এ দুটো প্রকৃত অর্থে হেপাটাইটিস ভাইরাস নয়।
হেপাটাইটিস রোগটি যেমন একিউট হতে পারে, তেমনি হতে পারে ক্রনিক। একিউট রোগটি ক্ষণস্থায়ী, গুরুতর হলেও কয়েক সপ্তাহে আরোগ্য হতে পারে, দেহের ওপর তেমন কুফল পড়ে না। ক্রনিক হেপাটাইটিস দীর্ঘ সময় থাকে, হয়তো বা জীবনভর। যেসব হেপাটাইটিস ভাইরাস ক্রনিক সংক্রমণের পথে যায়, এটি যকৃতের অনেক ক্ষতি ঘটাতে পারে। কারণ ভাইরাসের পুনর্জনন ঘটে যকৃতে। কালক্রমে অনেক যকৃৎকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, ধ্বংস হতে থাকে, ক্ষত শুকিয়েও যায়। তন্তুতে ভরে যেতে থাকে যকৃৎ। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘ফাইব্রোসিস’। ফাইব্রোসিস গুরুতর হলে যকৃৎ কঠিন হয়ে যায়, নিষ্ত্র্নিয় হয়ে যেতে পারে। একে বলে লিভার সিরোসিস।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস প্রতিরোধে কী করবেন
— হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের জন্য টিকা নেওয়া।
— নিরাপদ যৌনাচার (প্রোটেকশন ব্যবহার)।
— রক্ত ও রক্তজাতদ্রব্য স্পর্শ করার পর হাত ভালো করে ধোয়া।
— কাউকে ফার্স্ট এইড দেওয়ার সময়, রক্ত বা দেহ-তরল পরিষ্কার করার সময় হাতে গ্লাভ্স পরা।
— টুথব্রাশ, রেজার, সুচ, সিরিঞ্জ, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কাপড় অন্য কেউ ব্যবহার না করা।
— ইনজেকশন বা শেভ করার সময় একবার ব্যবহার্য (ডিসপোজেবল) সুচ-সিরিঞ্জ ও ব্লেড-রেজার ব্যবহার।
— সব ক্ষতকে ব্যান্ডএইড বা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখা।
— ব্যক্তিগত ব্যবহার্য-যেমন টিস্যু, স্যানিটারি প্যাড, টেমপুন, ব্যান্ডেজ-সিল করা ব্যাগে ভরে যথাযথ স্থানে ফেলা।
হেপাটাইটিস ‘বি’র টিকা থাকলেও ‘সি’ ভাইরাস প্রতিরোধের কোনো টিকা নেই।
সংক্রমিত রক্তের সরাসরি সংস্পর্শে এর সংক্রমণ ঘটে।
এ ছাড়া স্ক্রিনিং ছাড়া রক্তের ভরণ করলে; সংক্রমিত সুচ, সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে; দাঁতের চিকিৎসার জন্য সংক্রমিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে; রেজার, টুথব্রাশ, ঘরের জিনিসপত্র ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা হলে; নির্বীজন না করা হয়ে থাকলে যে যন্ত্রপাতি থাকবে সেগুলো দিয়ে কান ফুটো করা বা উল্কি আঁকা হলে এবং জন্মের সময় সংক্রমিত মায়ের কাছ থেকে শিশুর মধ্যে এর সংক্রমণ হতে পারে। হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস সংক্রমণের রয়েছে কার্যকর চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সম্ভবত বিশ্বে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়
— সংক্রমিত রক্ত ও রক্তজাত দ্রব্যের সংস্পর্শে না আসা।
— ইনজেকশনের যন্ত্রপাতি পরস্পর ব্যবহার না করা।
— ব্যক্তিগত টয়লেট দ্রব্য-যেমন রেজার, টুথব্রাশ, নেল ক্লিপার এবং ত্বক ফোটানো ও রক্ত গ্রহণের যন্ত্রপাতি অন্য কেউ ব্যবহার না করা।
— হাতের কাছে ফার্স্ট এইড কিট রাখা।
— ত্বকে কাটাছেঁড়া, ক্ষত পরিষ্কার রাখা ও ওয়াটারপ্রুফ ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখা।
— রক্তে ভেজা বা রক্তাক্ত যেকোনো দ্রব্য-যেমন টয়লেট দ্রব্য, স্যানিটরি প্যাড, টেমপুন, প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে যথাযথ স্থানে ফেলা।
——————-
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
প্রথম আলো, ২১ মে ২০০৮
Leave a Reply