১৯ মে সারা বিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত হলো বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বিশ্বে প্রতি ১২ জনে একজনের রয়েছে হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’। অথচ অধিকাংশই লোকই জানে না যে তাদের এ রোগ রয়েছে। এই পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সবাইকে জানতে হবে হেপাটাইটিস সম্পর্কে, সচেতন হতে হবে এ রোগের বিষয়ে। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্যকুশল-এর এই বিশেষ আয়োজন।
সারা বিশ্বে প্রতি ১২ জনে একজন হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ‘বি’-তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৫ কোটি এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ কোটি। সে হিসাবে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫২ কোটি লোক এই ভাইরাস দুটি শরীরে বহন করছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ লোক এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লিভার রোগের জটিলতা, যেমন-লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিওর অথবা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে মৃত্যুবরণ করে।
এই ভয়াবহতাকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব হেপাটাইটিস জোট গণসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এইচআইভি-এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’-কে গ্লোবাল হেলথ কেয়ার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসে এই জোট সারা বিশ্বে ‘আমি কি নম্বর ১২’ নামে ইন্টারনেটে একটি ওয়েবসাইট খুলেছে। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নাম অন্তর্ভুক্ত করে এই কার্যক্রমকে সমর্থন জানাচ্ছে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস
বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য-সমস্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, অভ্যাস, সামাজিক প্রথা, পরিবেশ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির ওপর এই ভাইরাসের উপস্থিতি ভিন্ন রকম।
এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আক্রান্ত এলাকা। বাংলাদেশ মধ্যম আক্রান্ত এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সাধারণ জন্ডিস থেকে লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।
রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ মূলত এই ভাইরাসের বাহক। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সাধারণত কোনো লক্ষণ বহন করে না, অথচ এদের মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তরস, লালা, বীর্য ও বুকের দুধ এক দেহ থেকে অন্য দেহে ভাইরাস বিস্তারে সহায়তা করে। আক্রান্ত মায়ের শিশুসন্তান, আক্রান্ত পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বহুবার রক্ত গ্রহণকারী রোগী, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি, স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথা হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ-যেমন চিকিৎসক, সেবিকা, ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ব্যক্তি, দন্তরোগের চিকিৎসকেরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
আকুপাংচার, মুসলমানি, নাক-কান ফোঁড়ানো, সিরিঞ্জ, সুচ, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, দন্ত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি, নাপিতের ক্ষুর ইত্যাদি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করার মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘বি’ ছড়ায়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস, এইডসের ভাইরাস (এইচআইভি) এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস একইভাবে যৌনমিলনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। পুরুষ সমকামী ও পতিতাদের মাধ্যমে সমাজে দ্রুত এই ভাইরাস বিস্তার লাভ করে।
কোন বয়সে একজন ব্যক্তি হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলো, তার ওপর এই রোগের প্রকৃতি নির্ভর করে। গর্ভাবস্থা, বিশেষত গর্ভাবস্থার তৃতীয় স্তরে (থার্ড টাইমেস্টার) মা ভাইরাস বহনকারী হলে পরবর্তী সময়ে জ্নগ্রহণকারী শিশুর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাপইটিস ‘বি’ ভাইরাস বিস্তার লাভ করে। প্রসবকালে ও বুকের দুধ পান করানোর সময়ও এই ভাইরাসের বিস্তার লাভ করার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। যদি একদম শিশুবয়সে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, যার চূড়ান্ত পরিণতি অকালমৃত্যু।
অন্যদিকে বয়স্ক লোকের বেলায় এই হার মাত্র শতকরা ৫-১০ ভাগ।
বাংলাদেশে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মানুষের মধ্যে শতকরা ৪.৪ থেকে ৭.৫ ভাগ এই ভাইরাস বহন করে। সুতরাং বাংলাদেশে বর্তমানে গড়ে ৮৫ লাখ লোক দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত।
আমাদের দেশে সাধারণ জনগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে কোনো রোগের লক্ষণ নেই, শুধু রুটিন-স্বাস্থ্য-পরীক্ষা বা টিকা নেওয়ার জন্য স্ক্রিনিং পরীক্ষা করাতে গিয়ে ‘এইচবিএসএজি’ ধরা পড়ে, এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়-বিদেশগামী দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৪.৪ থেকে ৭.৫ ভাগ, গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে ৩.৫ ভাগ, বস্তিবাসী লোকদের মধ্যে ৩.৮ ভাগ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬.৪ ভাগ, স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে ২.৩ ভাগ, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মধ্যে ২.৪ ভাগ ‘এইচবিএসএজি’ পজিটিভ।
একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগীদের শতকরা ১৯ থেকে ৩৫ ভাগ, দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগীদের শতকরা ৩৩.৩ থেকে ৪০.৫ ভাগ এবং লিভার ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে গড়ে ৪৫.৮ ভাগ লোক ‘এইচবিএসএজি’ পজিটিভ।
হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের মতো হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসও একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য-সমস্যা। এ ভাইরাস সাধারণ কোনো ব্যক্তিকে জন্ডিস থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত করতে পারে। বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা তিন ভাগ হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত, অর্থাৎ প্রায় ১৭০ মিলিয়ন মানুষ।
এবার আমাদের বাংলাদেশের চিত্র কেমন, দেখা যাক। যেখানে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মধ্যে সংক্রমণের হার শূন্য, সেখানে পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে শতকরা ১.২ ভাগ লোক এই ভাইরাস বহন করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগীদের মধ্যে শতকরা ২৪.১ ভাগ, লিভার ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯.৬ ভাগ, রক্ত গ্রহণের পর জন্ডিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬.৮ ভাগ, স্বল্পস্থায়ী জন্ডিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১.৭ ভাগ রোগী হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত।
ডেঙ্গু ভাইরাস বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক রোগীদের রক্ত এবং রক্ত উপাদান (প্লেটলেট) পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘সি’ ছড়াতে পারে।
যেহেতু আমাদের অধিকাংশ রক্তদানকেন্দ্রে রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয় না, তাই এটা আশঙ্কা করা অমূলক নয় যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে হেপাটাইটিস ‘সি’ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো টিকা বা প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধকেই একমাত্র গুরুত্ব দিতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’-উভয় ভাইরাসই ধীরে ধীরে লিভারকে ধ্বংস করে। এ জন্য রোগী বুঝতে পারে না এটি একটি নীরব ঘাতক। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাপান, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইতিমধ্যে বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনসহ সর্বজনীন হেপাটাইটিস ‘বি’ টিকা প্রচলন করেছে।
ফলে ওই সব দেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস বহুলাংশে কমে এসেছে। এসব রোগের চিকিৎসার ওষুধ আমাদের দেশে সব সময়ই পাওয়া যায়। তবে এগুলোর উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে ভালো। প্রতিরোধ শুরু হয় সচেতনতা থেকে। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত আলোচনা জরুরি। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি একটি বিরাট সফলতা। এর মাধ্যমে পোলিও রোগ মোটামুটি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।
এটা খুব খুশির খবর যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রতিরোধের জন্য এর টিকাকে ইপিআই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে হেপাটাইটিস ‘সি’র উপস্থিতি নির্ণয় করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে রক্তদানকেন্দ্রগুলোতে নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা বাড়াতে হবে।
————————–
অধ্যাপক মবিন খান
চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
প্রথম আলো, ২১ মে ২০০৮
Leave a Reply