মানুষের শরীর অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দিয়ে তৈরি। এসব কোষ তাদের সঠিক কার্যক্রম দ্বারা আমাদের জীবন নামক যন্ত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখে। কোষযন্ত্রের এই স্বাভাবিক কার্যক্রমের কারণেই শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক কাজ সম্পাদন করে।
কিন্তু একাধিক কারণে হঠাৎ কোনো কোনো কোষে দেখা যায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন। যার ফলে কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে সংখ্যায়ও দ্রুত বাড়তে থাকে। এই বৃদ্ধি স্বাভাবিক বৃদ্ধি নয়।
একপর্যায়ে এই পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এবং একসময় ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। এই অপরিপক্ক, অস্বাভাবিক, অনিয়ন্ত্রিত কোষ বৃদ্ধি শরীরকে দ্রুত অসুস্হ করে তোলে যা ক্রমেই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা খর্ব করে। শরীরের এই অসুস্হ অবস্হাকে বলে ক্যান্সার। নারী পুরুষ শিশু যুবক নির্বিশেষে যে কোনো বয়সের মানুষের ক্যান্সার হতে পারে।
সারা বিশ্বে বর্তমানে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ক্যান্সার মৃত্যুর হার উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশেই সবচেয়ে বেশি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এবং সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী দশ বছরে এইচআইভি-এইডস, ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মায় সম্মিলিত মৃত্যুর চেয়েও ক্যান্সারের মৃত্যুর আশংকা বেশি। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যদিও আমাদের দেশে ক্যান্সার রোগীদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবু বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও পত্রপত্রিকায় লেখা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতি বছর প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ লোক নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
এই ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই আর্থিক কারণে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। বাকি রোগীদের প্রায় বেশিরভাগই আধুনিক চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না। তাই ক্যান্সার একটি পরিবারকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। একটি পরিবারের আর্থিক/মানসিক সবটুকুই নিঃশেষ হয়ে যায় একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায়।
তাই আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ক্যান্সার সচেতনতা ও প্রতিরোধ। প্রাথমিক অবস্হায় রোগ নির্ণয় করতে পারলে আমরা অনেকের জীবনে হাসি ফিরিয়ে আনতে পারি।
প্রথমে ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গগুলো সবাইকে জানানো দরকার। অর্থাৎ কখন একজন লোক ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন। মনে রাখতে হবে, এসব উপসর্গ হলেই যে সেটা ক্যান্সার হবে, তা নাও হতে পারে।
প্রাথমিক উপসর্গ
১. বেশ কিছুদিন ধরে খুশখুশে কাশি বা ভাঙা কণ্ঠস্বর।
২. শরীরের কোথাও এমন ‘ঘা’ বা ‘ক্ষত’ যা অনেকদিন সারছে না।
৩.
শরীরের যে কোনো স্হান থেকে অস্বাভাবিক রক্ষক্ষরণ।
৪. স্তন বা শরীরের অন্য কোথাও কোনো পিন্ড বা চাকা।
৫. খাবার গিলতে অসুবিধা বা পেটের গন্ডগোল।
৬. মলমুত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন।
৭. শরীরের তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন।
উপরের উপসর্গগুলো দু’সপ্তাহের বেশি স্হায়ী হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আবার শিশুকালের ক্যান্সারের ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়ঃ
–অনিয়মিত দৈহিক বৃদ্ধি।
–দীর্ঘস্হায়ী এবং সুপ্ত জ্বর।
–ফ্যাকাসে ভাব, শক্তিক্ষয় এবং দ্রুত ওজন হ্রাস।
–সুপ্ত এবং দীর্ঘস্হায়ী ব্যথা, মাথাধরা এবং প্রায়ই বমি বমি ভাব।
–সহজে কালশিরা পরা এবং অজ্ঞাত রক্তক্ষরণ।
–ভারসাম্য এবং ব্যবহারে হঠাৎ পরিবর্তন।
–স্ফীত মাথা।
–চোখে উজ্জ্বল সাদা দীপ্তি।
শিশুকালের ক্যান্সারের মধ্যে রয়েছে বেশিরভাগই লিউকোমিয়া ও লিম্ফোমাস। তাছাড়া আছে নিওরোব্লাসটোমা, রেটিনোব্লাসটোমা, রেনাল ক্যান্সার ইত্যাদি।
আমরা সহজ স্বাভাবিক জীবনকেই ভালোবাসি। এই স্বাভাবিক জীবনই মানুষকে দেয় সুস্হতা। আমরা বলতে চাই ধুমপান, তামাক, জর্দা, অধিক চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করুন। মেয়েরা বিশের কমে বিয়ে ও অধিক সন্তান গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। বেশি করে শাকসবজি ও ফলমুল খাওয়া এবং সন্তানকে বুকের দুধ দেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
ধুমপান ও পরিবেশ দুষণের কারণে বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে ফুসফুসের ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি। মেয়েদের মধ্যে জরায়ুমুখ ও স্তনের ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি। মুখ গহ্বর ও নাক-কান-গলার ক্যান্সারও আমাদের দেশে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপর লিভার, পাকস্হলী, অন্ত্র ও রক্ত ক্যান্সারসহ সব ধরনের ক্যান্সারেই এখন অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে।
আমাদের উচিত পরিমিত আহার ও হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর হালকা-পাতলা রাখা। চর্বিজাতীয় খাদ্য পরিহার করা। শাকসবজি ও ফলমুল বেশি পরিমাণে খাওয়া। শিশুকে বুকের দুধ পান করানো। জর্দা, তামাক, ধুমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা। গৃহে কোনো অবস্হাতেই মহিলা বা বাচ্চাদের পাশে ধুমপান না করা। যে কোনো মাদক থেকে মুক্ত থাকা। ধর্মীয় নীতি অবলম্বন করে জীবনযাপন করা ও মনকে প্রফুল্ল রাখা।
আমাদের মনে রাখা উচিত, একমাত্র ধুমপান পরিহার করতে পারলে বা ধুমপান থেকে বিরত থাকলে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, পক্ষাঘাত, ষ্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ বহু রোগ থেকে নিজেকে সুস্হ রাখা যায়।
অনেক মহিলাই স্তনের চাকা দেখে ক্যান্সার মনে করে ভয় পেয়ে যান। কিন্তু মনে রাখবেন, স্তনের চাকার বেশিরভাগই (বিনাইন) বা ক্ষতিহীন। তাই লজ্জা-সংকোচ বাদ দিয়ে, অলসতা বর্জন করে অবিলম্বে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
—————–
ডা. দবির আহমেদ
আমার দেশ, ২০ মে ২০০৮
Leave a Reply