ডায়াবেটিস স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামই কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট।
যে কয়টি অসুখ মানুষের দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তীর সৃষ্টি করে তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে ডায়াবেটিস-এর উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। ইনসুলিনের অভাব হলে শরীরে শর্করা, আমিষ এবং চর্বিজাতীয় খাবারের বিপাক যথাযথভাবে সংঘটিত হতে পারে না। এতে শরীরে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট-এর স্বাভাবিক সমতাও বিনষ্ট হয়। দীর্ঘমেয়াদী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের প্রায় প্রতিটি তন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কিডনী, হ্নৎপিন্ড, চোখ, কান, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র, অস্থিসন্ধি এবং প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যহত করে থাকে। ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কখনও কখনও স্ট্রোক, অন্ধত্ব অঙ্গহানি কিংবা মৃত্যুর মত মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে।
সংক্রামক রোগের মত ডায়াবেটিস-এর সুনিদিষ্ট কোন কারণ জানা যায়নি। তবে বংশগতি বা পারিবারিক প্রবণতা, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, মুটিয়ে যাওয়া, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, কম শারীরিক পরিশ্রম তথা সার্বিক জীবন-যাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিস-এর নিবীড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। পূর্বে উল্লিখিত বিষয়গুলো ডায়াবেটিস-এর ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে ওজন বেড়ে যাওয়াকে ডায়াবেটিস-এর অন্যতম প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হয়। তাই জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়াবেটিস-এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের একটি পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে চিকিৎসার পাশাপাশি এর প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অধিকমাত্রায় ক্লান্তি বোধ করা ডায়বেটিসের সাধারণ উপসর্গ। কখনও কখনও ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও এসব উপসর্গ অনুপস্থিত থাকতে পারে। কারও ডায়বেটিস-এর লক্ষণ থাকলে কিংবা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারও ডায়াবেটিস থাকলে রেজিষ্টারড চিকিৎসকের পরামর্শ মত ডায়াবেটিস নির্ণয়ের ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করতে হবে। এতে আগেভাগে ডায়াবেটিস নির্ণয় করে এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে ডায়াবেটিস-এর মারাত্মক সব জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে। ডায়াবেটিস-এর কারণ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কার্যকর স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ তথা সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতি বছর ২৮শে ফেব্রুয়ারি “জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস” হিসেবে পালিত হয়। এ দিবসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করে এর প্রতিরোধ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন করা।
ডায়াবেটিস স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামই কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট। এর সাথে কারও কারও মুখে খাওয়ার ওষুধ-এর প্রয়োজন হয়। কারও আবার প্রয়োজন হয় ইনসুলিন ইনজেকশনের। তবে সকল ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন আবশ্যক। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে এবং ডায়াবেটিস-এর জটিলতামুক্ত সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে নিচের টিপসগুলো মেনে চলা প্রয়োজনঃ
১· আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করুন।
২· অতিরিক্ত লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবার যথাসম্ভব পরিহার করুন। প্রতিদিন কিছু পরিমাণ শাক-সবজি ও ফলমূল খান।
৩· ফাস্ট-ফুড এবং কোল্ড-ড্রিংক্স পরিহার করুন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
৪· বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত রিচ ফুড যথাসম্ভব পরিহার করুন।
৫· ওজন নিয়ন্ত্রণের চমৎকার একটি উপায় হচ্ছে হাঁটা। তাই কম দূরত্বের জায়গাগুলোতে হেঁটে চলাচল করুন।
৬· লিফ্ট-এর বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
৭· একটানা অধিক সময় বসে কাজ করবেন না। কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পাঁয়চারি করুন।
৮· অলসতা দূর করতে সংসারের টুকিটাকি কাজ নিজেই করুন। সুযোগ থাকলে বাগান করুন, খেলাধুলা করুন। সাঁতার কাটুন।
৯· সপ্তাহে তিন/চার দিন কিছু সময় ফ্রি-হ্যান্ড (যন্ত্র ছাড়া) ব্যায়াম করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত ব্যায়াম নির্বাচন করুন। কারণ সব ব্যায়াম সবার জন্য উপযুক্ত নয়। ব্যায়াম করছেন এ ধারণা মাথায় রেখে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করবেন না।
১০· কোমড়ে চওড়া বেল্ট ব্যবহার করতে পারেন। এতে মেদ দ্রুত বাড়তে পারবে না।
১১· প্রচলিত বিজ্ঞাপনের চমকে আকৃষ্ট হয়ে দ্রুত চিকন হওয়ার ওষুধ বা যন্ত্র ব্যবহার করতে যাবেন না। এতে আপনার অমঙ্গলের আশংকাই বেশী।
১২· প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শমত আপনার মুটিয়ে যাওয়ার মাত্রা নির্ণয় করে বয়সানুসারে সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরী করুন।
১৩· ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমত চিকিৎসা গ্রহণ করুন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্যগ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপন সংক্রান্ত তার সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনা (যা শুধুমাত্র আপনার জন্য প্রযোজ্য) মেনে চলুন।
———————-
ম ডাঃ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান খান
জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ মে ২০০৮
Leave a Reply