প্রথম বিশ্ব হাঁপানি দিবস পালিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, বিশ্বের ৩৫টি দেশে। সেই সঙ্গে প্রথম বিশ্ব হাঁপানি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্পেনের বার্সেলোনায়। এর পর থেকে এ দিবসটি আরও গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে পৃথিবীর নানা দেশে। একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে হাঁপানি রোগ বিশ্বজুড়ে বিবেচিত হয়ে আসছে। বায়ুপথের এই ক্রনিক রোগটি বিশ্বের নানা দেশের সব বয়সের মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে দৈনন্দিন জীবন যাপনে আসে সীমাবদ্ধতা, অনেক সময় ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে রোগী।
হাঁপানি ক্রমেই বাড়ছে পৃথিবীতে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। রোগ যত বাড়ছে, স্বাস্থ্য-পরিচর্যার ব্যয়ও তত বাড়ছে; উৎপাদনশীলতাকেও এটি খর্ব করছে, বাড়ছে পরিবারের ভোগান্তি।
অথচ গত দুই দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন সব অগ্রগতি হয়েছে, এ রোগ সম্পর্কে অনেক বেশি জেনেছি আমরা, একে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নতুন নতুন পথের সন্ধানও পাওয়া গেছে। তবে চিকিৎসাটি স্থানীয় পরিস্থিতি ও পরিবেশ-উপযোগী হওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মী ও পেশাজীবী হাঁপানি চিকিৎসার উপায় এবং এর ব্যয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া উচিত; কীভাবে এই ক্রনিক রোগ মোকাবিলা করা যায় কার্যকরভাবে, এও জানা উচিত। জনগণেরও হাঁপানি পরিচর্যা ও পরিষেবা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা উচিত। ১৯৯৩ সালে ন্যাশনাল হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট, আমেরিকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে একটি কর্মশালা হয় এবং ‘পরবর্তী সময়ে হাঁপানি ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধ সম্বন্ধে বৈশ্বিক কৌশল’ নামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল-হাঁপানি-ব্যবস্থাপনার একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়ন। লক্ষ্য হলো, ক্রনিক এই রোগের প্রকোপ হ্রাস এবং এ থেকে মৃত্যু কমিয়ে আনা; আর হাঁপানি রোগীরা যাতে একটি কর্মক্ষম পূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন, এর ব্যবস্থা করা। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফর অ্যাজমা’ (জিআইএনএ), যারা প্রতিবছর বিশ্ব হাঁপানি দিবসের আয়োজন করে আসছে। জিআইএনএর সর্বশেষ যে গাইড লাইন ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এতে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ বছর বিশ্ব হাঁপানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি জিআইএনএর গাইড লাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হাঁপানি চিকিৎসার লক্ষ্য হলো ‘হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ’ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক রোগীকে এর আওতায় আনা।
একজন রোগীর হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কি না, তা বোঝার জন্য যে সূচকগুলো জানা উচিত-
- হাঁপানির উপসর্গ থাকে না বা থাকলেও অত্যন্ত মৃদু মাত্রায় থাকে।
- হাঁপানির কারণে রাতে ঘুম থেকে উঠতে হয় না।
- হাঁপানির জন্য ওষুধ লাগছে না বা লাগলেও খুব কম পরিমাণে লাগে।
- স্বাভাবিক কাজকর্ম ও ব্যায়াম করার ক্ষমতা রয়েছে।
- ফুসফুসের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করে (পিইএফ এবং এফইভি১) ফলাফল স্বাভাবিক বা প্রায় স্বাভাবিক পাওয়া গেছে।
- হাঁপানির আক্রমণ ঘটার ঘটনা খুব কম।
- হাঁপানি নিয়ন্ত্রণকে অর্জন করার এবং একে বজায় রাখার কৌশল ‘জিআইএনএ গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি ফর অ্যাজমা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এ কৌশলপত্রে বর্ণিত রয়েছে। এ কৌশলপত্রে চিকিৎসার চারটি পরস্পর সম্পর্কিত উপকরণের কথা বলা হয়েছে-
- রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক ও অংশীদারি।
- ঝুঁকি উপাদানগুলো চিহ্নিত করা এবং এর মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা হ্রাস করা।
- হাঁপানি নির্ণয়, চিকিৎসা ও তদারক করা।
- হাঁপানির আক্রমণের ব্যবস্থাপনা।
এ কৌশল অবলম্বন করে এই অসুখ নিয়ন্ত্রণ করা এবং একে বজায় রাখার জন্য চিকিৎসা করতে হয় ধাপে ধাপে। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে না এলে ওষুধ বাড়াতে হয় এবং একবার তা নিয়ন্ত্রণে এলে এবং বেশ কিছু সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণটি বজায় থাকলে ওষুধ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে হয়।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নিজের হাঁপানি নিজেই নিয়ন্ত্রণ’ উৎসাহিত করে তুলবে দেশের সরকার, স্বাস্থ্য-পরিচর্যা পেশাজীবী, রোগী ও জনগণকে-নিজ নিজ দেশের স্বাস্থ্য-পরিচর্যাব্যবস্থার মধ্যে সবাই মিলে গড়ে তুলবে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা।
দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে সচরাচর দৃষ্ট ক্রনিক রোগ হলো হাঁপানি। শিশুদের মধ্যে এটি বাড়ছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এক থেকে ৩০ শতাংশের বেশি শিশুর রয়েছে হাঁপানি। তবে সৌভাগ্যবশত এর কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব। বেশির ভাগ রোগী সন্তোষজনক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে রোগকে। দিন-রাতে উপসর্গগুলো আর থাকে না। ওষুধও তেমন লাগে না। সক্রিয়, সজীব জীবন যাপন করতে পারে। ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হয় স্বাভাবিক। এর আক্রমণও হঠাৎ ঘটে না। হাঁপানি হলে রোগীর মধ্যে বারবার দেখা যায় ও শোনা যায় বুকে শনশন শব্দ আর শ্বাসকষ্ট, বুক আঁটসাঁট হয়ে যাওয়া, কফ-কাশ, বিশেষ করে রাতে বা খুব ভোরে।
বায়ুপথে প্রদাহ হয়ে বিকল হয়ে যায়-রোগটি হলো ক্রনিক। ক্রনিক প্রদাহজনিত বৈকল্য হলো হাঁপানি, এই প্রদাহ হয় বায়ুপথে। বায়ুপথগুলো তখন হয়ে ওঠে প্রচণ্ড সংবেদনশীল। বায়ুপথ হয় রুদ্ধ, বায়ু চলাচল হয় খুবই কম। বায়ুপথের একটি অংশ ক্লোমনালি হয় সংকুচিত, শ্লেষ্মা জমে পথ হয় রুদ্ধ, প্রদাহ তখন একে আরও জটিল করে তোলে। বিভিন্ন ঝুঁকি-উপাদানের মুখোমুখি রোগ হয়ে ওঠে প্রবল।
সাধারণ ঝুঁকিগুলো হলো
এলার্জেনের মুখোমুখি হওয়া, যেমন-ঘরের ধুলা ও ময়লা, পোকা-কীট, পশুর রোম, তেলাপোকা, পরাগরেণু ও ছত্রাক।
অন্যান্য ঝুঁকি হলোঃ পেশাগত উত্তেজক পদার্থ, সিগারেটের ধোঁয়া, শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাল রোগ, তীব্র আবেগ, রাসায়নিক উত্তেজক পদার্থ এবং ওষুধ (যেমন এসপিরিন ও বিটাব্লকার ওষুধ)। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ করা এবং তা বজায় রাখার জন্য ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয় ধাপে ধাপে। এতে চিকিৎসা হয় নিরাপদ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকে নজর দিতে হয়, চিকিৎসার খরচও বিবেচ্য বিষয়।
এ জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে, পরিবার ও সমাজের ওপর এর বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। এ রোগের নিয়ন্ত্রণ তেমন হচ্ছে না তা বলা বাহুল্য। হাঁপানির সঠিক দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা না হলে নিয়ন্ত্রণ ভালো হয় না। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় গুরুতর হাঁপানি হয়ে হাসপাতালবাস, জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্রে গমন, জরুরি পরিচর্যা হচ্ছে অনেকেরই। নিয়ন্ত্রণ ভালো না হওয়ায় অনেকের জীবনযাপন হচ্ছে সীমিত। এই নিয়ন্ত্রণ অর্জনের পথে বাধাগুলো হলো, অনেকের হাঁপানি নির্ণয় হচ্ছে না, ওষুধ ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না। কোনো কোনো অঞ্চলে হাঁপানির ওষুধও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। অনেকের চিকিৎসা ঠিকমতো হয় না, অনেক অঞ্চলে মানুষ স্বাস্থ্য-পরিচর্যার আওতায়ও নেই। অনেকের হাঁপানি রোগ, এর নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ব্যবহারবিধি, কখন সহায়তা ও পরামর্শ নিতে হবে-এসব সম্পর্কে ধারণাই নেই। নিয়ন্ত্রণকে উন্নত করার জন্য শ্বাসের সঙ্গে স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহার অনেক দেশে বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে।
অনেক দেশে ‘জাতীয় হাঁপানি অভিযান’ হাঁপানি রোগে রুগ্ণতা ও মৃত্যু অনেক হ্রাস করেছে। হাঁপানির রয়েছে কার্যকর চিকিৎসা। সঠিক রোগ নির্ণয়, হাঁপানি সম্পর্কে সচেতনতা ও চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক রোগী নিজেরাই রোগকে আনতে পারবে নিয়ন্ত্রণে।
————————————-
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর
কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
দৈনিক প্রথম আলো, ০৭ মে ২০০৮
Leave a Reply