মলদ্বারের ব্যথায় অনেক লোক ভুগে থাকেন। যে রোগে মলদ্বারে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হয় তার নাম এনাল ফিসার। সাধারণত শক্ত মল হলে বা ঘন ঘন মলত্যাগের কারণে মলদ্বার ফেটে ঘা হয়ে যায়। সমস্যা হলো এই যে, এই ঘা শুকাতে চায় না সহজে। আবার কিছু কিছু রেগীর এই ঘা শুকিয়ে গেলেও কিছু দিন পর মল শক্ত হলে একই সমস্যা আবার দেখা দেয়। এই রোগ একজন রোগীর বছরের পর বছর এমনকি ৩০-৪০ বছর থাকতে দেখেছি। এ রোগের উপসর্গেরও বেশ তারতম্য হয়। কোনো কোনো রোগীর মলত্যাগের পর সামান্য জ্বালাপোড়া হয় এবং তা ৫ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত চলে। আবার কখনো কখনো ব্যথা তীব্র আকার ধারণ করে এবং কয়েক ঘণ্টা এমনকি সারাদিন চলতে থাকে। কারো কারো মাথা ধরে যায়। আবার দীর্ঘস্থায়ী এনাল ফিসারে মাঝে মধ্যে মোটেই ব্যথা থাকে না। আমার ব্যক্তিগত মতে মলদ্বারে রোগের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি হয়। জনসাধারণ এ রোগটিকে সাধারণত পাইলস হয়েছে বলে মনে করে থাকেন। এটি যেকোনো বয়সে হতে পারে। আমি দেড় মাসের শিশুকে এ রোগ হতে দেখেছি। তবে তরুণ ও যুবাদের বেশি হয়। পুরুষ অথবা নারী উভয়ের এ রোগটি সমানভাবে হয়ে থাকে।
কারণ এবং কী করে ঘটে?
এটি হওয়ার জন্য সাধারণত দায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা মলত্যাগের সময় কোঁত দেয়া। শক্ত মল বের হওয়ার সময় মলদ্বার ফেটে যায় বলে মনে করা হয়। যারা আঁশযুক্ত খাবার খান তাদের এ রোগ কম হয়। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে শাকশবজি, কাঁচা ফলমূল, আলু, ইসুপগুলের ভুসি ইত্যাদি। চা কফি বা মদ খাওয়ার সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ঘন ঘন মলত্যাগ বা ডায়রিয়া হলে ফিসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদিও আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করলে মলদ্বার অতিরিক্ত সঙ্কুচিত বলে মনে হয়। মলদ্বারের ভেতর সাপোজিটর-জাতীয় ওষুধ দেয়ার সময় অনেকের মলদ্বারে যে ঘা হয় তা থেকেও অনেক রোগীর বিশেষ করে মহিলাদের এজাতীয় রোগ হতে দেখেছি।
উপসর্গ ও লক্ষণ
মলদ্বারে ফিসারের প্রধান লক্ষণ হলো ব্যথা, জ্বালাপোড়া ও রক্তক্ষরণ। এ ধরনের ব্যথা সাধারণত মলত্যাগের অব্যবহিত পরে হয় এবং কয়েক মিনিট থেকে বহু ঘণ্টা এমনকি সারাদিনও চলতে পারে। প্রকটালজিয়া ফিউগাক্স নামক একধরনের রোগেও মলদ্বারে ব্যথা হয় কিন্তু তা মলত্যাগের অব্যবহিত পরেই হয় না, দিনের যেকোনো সময় হতে পারে। পাইলসের জটিলতা যেমন রক্ত জমাট বাঁধা, আলসার বা গ্যাংগ্রিন হলেও মলদ্বারে প্রচুর ব্যথা হয়; কিন্তু তখন রোগী মলদ্বারে বড় একটি মাংসপিণ্ড আছে বলে অভিযোগ করেন। মলদ্বারে সংক্রমণ হয়ে ফোঁড়া হলে, ফিস্টুলা বা ভগন্দর এবং দুরারোগ্য ক্যান্সারেও ব্যথা হয়। এসব ক্ষেত্রে রোগের ইতিহাস ও রোগীকে ফিজিক্যাল পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করতে হয়।
এই রোগে রক্তক্ষরণের পরিমাণ সাধারণত কম। তবে আমি অনেক রোগী দেখেছি যারা বলেন মুরগি জবাই করলে যেরূপ রক্ত পড়ে তেমন রক্ত যায়। কিছু দিন আগে অল্পবয়সী এক অফিসারকে চিকিৎসা করেছি যার তীব্র রক্তশূন্যতা হয়েছিল। দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) মলদ্বারের ফিসারের রোগী একটু ভিন্ন ধরনের উপসর্গের কথা বলেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে থাকে মলদ্বারে অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড, পুঁজ পড়া, চুলকানি ইত্যাদি। এসব উপসর্গ একত্রে অথবা আলাদা আলাদাভাবে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ থাকতে পারে আবার না-ও থাকতে পারে। ব্যথা সাধারণত তীব্র হয় না আবার অনেক সময় ব্যথা একেবারেই থাকে না।
ফিসারের রোগীরা অনেক সময় প্রস্রাবের সমস্যায় ভোগেন। অনেকে বহুদিন ধরে প্রস্রাব করতে কষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। জয়পুরহাটের একজন ডাক্তার দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যাবৎ ফিসারে ভুগছিলেন। তিনি মলত্যাগের পাশাপাশি প্রস্রাবেও কষ্ট পাচ্ছিলেন। অভিজ্ঞ সার্জন দ্বারা মূত্রনালীর অপারেশন করিয়েছেন। খুব উপকার হয়নি। ইন্ডিয়া গিয়ে দেখিয়েছেন। সম্পূর্ণ ভালো হননি। আমি এনাল ফিশারের অপারেশন করার পর প্রস্রাব করতে সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান। এরূপ আরো অনেক রোগী রয়েছেন।
এ রোগে মহিলারা কখনো কখনো যৌন মিলনে ব্যথা অনুভব করেন। যদিও রোগীরা বুঝতে পারেন যে কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে এ সমস্যাটির উদ্ভব হয়েছে তবু ব্যথার ভয়ে রোগীরা টয়লেটে যেতে চান না। এভাবে কোনো কোনো রোগী ৫-১০ দিন পর একবার টয়লেটে যান। আবার এরূপ রোগী পেয়েছি যাদের অতিরিক্ত মল আটকে রাখার কারণে মলত্যাগ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে এবং মল চুইয়ে পড়ে কাপড় নষ্ট হয়। তখন রোগী বলেন, আমি মল ধরে রাখতে পারছি না। আসলে সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করালে এমনটি হওয়ার কথা নয়।
তীব্র ব্যথাসম্পন্ন ঘা
এ অবস্থায় রোগীরা ভীষণ ব্যথায় ভোগেন। কয়েক ঘণ্টা থেকে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকেন। এ সময় মলদ্বার পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে সেটি খুবই সঙ্কুচিত অবস্থায় আছে। তীব্র ব্যথার কারণে ভেতরের ঘা দেখা দুঃসাধ্য। কোনো যন্ত্রও প্রবেশ করানো যায় না। অনেক রোগী তীব্র ব্যথার জন্য মলদ্বার স্পর্শ করতে দিতে চান না।
দীর্ঘস্থায়ী মলদ্বারের ঘা
ক্রনিক ফিসার বলা হয় যখন একটি সঠিকভাবে চিহ্নিত সীমার মধ্যে ঘা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি বাড়ন্ত মাংসপিণ্ড বা গেজ দেখা যায়। এটিকে বলা হয় সেন্টিনেল পাইলস। মলদ্বারের ভেতরেও একটি টিউমারের মতো মাংসপিণ্ড দেখা যায় তাকে বলা হয় Hypertrophied anal papilla..
এটি কোনো ক্যান্সার বা টিউমার নয়। এ ক্ষেত্রে পায়ুপথের ভেতর যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত যাতে টিউমার বা প্রদাহজনিত কারণ চিহ্নিত করা যায়। এই ফিসার সংক্রমিত হয়ে কখনো কখনো ফোঁড়া দেখা দিতে পারে এবং তা থেকে ফিস্টুলা (ভগন্দর) হয়ে পুঁজ পড়তে পারে। এ ঘা থেকে সব সময় কিছু রস নিঃসরণ হওয়ায় চুলকানি দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধ
কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা উচিত এবং বেশি শক্তি প্রয়োগে মলত্যাগ করা উচিত নয়। বারবার মলত্যাগের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং ডায়রিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে।
চিকিৎসা
সীমিত চিকিৎসা
রোগটি শুরুর অল্প দিনের ভেতরে চিকিৎসা শুরু করা হলে বিনা অপারেশনে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রথম প্রথম সামান্য জ্বালাপোড়া এবং একটু রক্তক্ষরণ ছাড়া তেমন সমস্যা থাকে না তাই কেউ ডাক্তারের কাছে যান না। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি রোগটি যখন বারবার হচ্ছে এবং ব্যথা কিছুটা তীব্র হচ্ছে তখনই ডাক্তারের কাছে আসেন। ততক্ষণে রোগটি ক্রনিক হয়ে গেছে। এর পরেও আমি ওষুধ দিয়ে ১ মাস সেবন করতে বলি। যদি ভালো হয়ে যান তাহলে বিশেষ ধরনের খাবারের উপদেশ দিয়ে বলি যদি কোনো দিন অসুবিধা হয় তাহলে আসবেন। কিন্তু ১ মাস বা দু’মাসের ওষুধেও যদি ভালো না হয় তখন অপারেশন করতে উপদেশ দিই।
ওষুধের মধ্যে রয়েছে মল নরম করার এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করার ওষুধ। আঁশজাতীয় খাবার যেমন সবজি, টাটকা ফলমূল, ইসুপগুলের ভুসি খাওয়া যেতে পারে। ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। সিজ বাথ (Sitz bath) নিলে উপকার পাওয়া যায়। এটির নিয়ম হচ্ছে আধ গামলা লবণ মিশ্রিত গরম পানিতে নিতম্ব ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। মলদ্বারের ব্যথানাশক মলম ব্যহার করতে হয়। এতে যদি পুরোপুরি উপকার না পাওয়া যায় এবং রোগটি যদি বেশি দিন চলতে থাকে তাহলে অপারেশন করিয়ে নেয়া ছাড়া ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে।
সার্জিক্যাল চিকিৎসা বা অপারেশন
এ রোগের জন্য অপারেশন করতে হতে পারে এ কথা শুনলেই রোগীদের আত্মা শুকিয়ে যায়। রোগীরা বলেন, স্যার, এমনিতেই এত ব্যথা টয়লেটে যেতে পারি না; তার ওপর অপারেশন করলে টয়লেট করব কী করে? আবার এই রোগীরাই যখন অপারেশনে রাজি হন তখন অপারেশনের পর বলেন, স্যার, গত ১৫ বছর পর এই প্রথম আরাম করে পায়খানা করলাম। অনেকে বলেন, স্যার, টয়লেটে এখন এত আরাম পাচ্ছি যে, তখনই আপনার জন্য দোয়া করি। আসলে মলদ্বারের এই ফিসার বা ঘা না শুকানো পর্যন্ত রোগীর সমস্যা চলতে থাকে। টয়লেটে গেলে মল বেরিয়ে আসতে চায় না। অনেক সময় নষ্ট করে এবং নানা কসরত করে রোগীকে মলত্যাগ করতে হয় এমনকি বায়ু বের করতেও কষ্ট হয়। ওষুধে না সারলে অপারেশনই এই ঘা শুকাবার একমাত্র পথ এবং তার পরই সব সমস্যার সমাধান হবে। অপারেশনের অব্যবহিত পরই রোগী আরামে মলত্যাগ করতে পারবেন কিন্তু অপারেশনের ঘা শুকাতে ২-৪ সপ্তাহ লাগতে পারে। তবে রোগী ৫-১০ দিনের মধ্যে কাজে যোগদান করতে পারেন। অপারেশনের জন্য হাসপাতালে মাত্র ২-৩ দিন থাকতে হয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক যে প্রশ্নটি সর্বদা শুনতে হয় তা হলো, রোগীরা বলেন, স্যার, শুনেছি এই রোগ অপারেশন করলেও বারে বারে হয় তাই আর অপারেশন করিয়েই বা লাভ কী? আমি জানি না কোথা থেকে বেশিরভাগ রোগী এমনকি বিদেশে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন এমন রোগীও একই ধারণা পোষণ করেন। এ কথা বলার সময় অনেক রোগী কোনো কোনো ডাক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, তিনি বলেছেন, আপনাকে সারাজীবন এ সমস্যা নিয়েই চলতে হবে। যা ওষুধ দিয়েছি এগুলো এবং বেলের শরবত খাবেন। মল নরম রাখবেন। এভাবে যত দিন চলতে পারেন। অপারেশন করিয়ে লাভ নেই আবার এটি হতে পারে।
এর উত্তরে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, এ রোগের অপারেশনের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে ৯৫-৯৯ শতাংশ এবং আবার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিগত ৯ বছরে আমি এ ধরনের শত শত অপারেশন করেছি এবং ৯৭ শতাংশ রোগী ভালো হয়েছেন সম্পূর্ণরূপে।
অপারেশন পদ্ধতি
ক) মলদ্বারের মাংসপেশির সম্প্রসারণ (Anal dilatation)-এ পদ্ধতিটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সাফল্য খুবই সামান্য বলে বেশিরভাগ সার্জন এর বিপক্ষে।
খ) মলদ্বারের অভ্যন্তরীণ বৃত্তাকার মাংসপেশি কেটে দেয়া (Lateral Internal Sphincterotomy) এই অপারেশনে মলদ্বারের অভ্যন্তরীণ স্ফিংটারে (Sphincter) একটি সূক্ষ্ম অপারেশন করতে হয়। এটির কৌশলগত হেরফের হলে মল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। অজ্ঞান না করে অপারেশন করা যায়। ১-২ দিন পর রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারে। তবে কাজে যোগদান করতে ৫-১০ দিন লাগতে পারে। বিদেশে রোগ জটিল হওয়ার আগেই অপারেশন করা হয়। ফলে তারা অল্প সময় পরে স্বাভাবিক কাজ করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে যাদের চিকিৎসা করি তারা শুধু এনাল ফিসার নিয়েই আসেন না, এর যে জটিলতা আছে অর্থাৎ ফোঁড়া, ফিস্টুলা Hypertrophied anal papilla এসব নিয়ে আসেন ফলে এর অপারেশনে বিভিন্ন ধরনের রোগের জন্য কাটাছেঁড়া করার কারণে সুস্থ হতে অনেক বেশি সময় লাগে।
আমি অপারেশনের তিন ঘণ্টা পর তরল খাবার এবং ছয় ঘণ্টা পর স্বাভাবিক খাবার খেতে দিই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ফলে বেশিক্ষণ না খাইয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। অপারেশনের ১-২ দিন পর রোগী চলে যেতে পারে। এরপর ৭ দিন অন্তর একবার চেকআপের জন্য আসতে হয়। না এলে কোনো জটিলতা হলে শনাক্ত করতে অসুবিধা হয়।
————————-
অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক
লেখকঃ বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ চেয়ারম্যান, কলোরেকটাল সার্জারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চেম্বারঃ জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ৫৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা।
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০৩ মে ২০০৮
Leave a Reply