শরীরে রক্ত কমে গেছে বা রক্ত নেই—এমন কথা অনেকে বলে থাকেন। আসলে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়ায় শরীরে রক্ত কমে যায় না, বরং রক্তের একটি উপাদান হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বয়স ও লিঙ্গ ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা ১৩ থেকে ১৭ গ্রাম/ডেসিলিটার এবং নারীর জন্য ১২ থেকে ১৫ গ্রাম/ডেসিলিটার।
দুর্বল লাগা মানেই রক্তশূন্যতা?
অনেকে দুর্বল লাগলে না বুঝে আয়রন ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন। কারও কারও আবার ধারণা, শিরায় রক্ত না পাওয়ার কারণও বুঝি রক্তশূন্যতা। রক্তশূন্যতা হলে দুর্বলতা ছাড়াও মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, ফ্যাকাসে ভাব, বুক ধড়ফড়, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হতে পারে। লক্ষ রাখবেন, দুর্বলতার আরও নানা কারণ থাকতে পারে, রক্তশূন্যতাই একমাত্র কারণ নয়।
রক্তশূন্যতা মানেই লৌহের অভাব?
হিমোগ্লোবিন প্রস্তুতের জন্য শরীর লৌহ বা আয়রন ব্যবহার করে থাকে। তাই আয়রনের ঘাটতি রক্তশূন্যতার একটি অন্যতম কারণ। তাই বলে রক্তশূন্যতা যে সব সময় আয়রনের অভাবেই হয়, তা নয়। লোহিত কণিকার অকাল ক্ষয় বা কম তৈরি হওয়া থেকে রক্তশূন্যতা হতে পারে। জন্মগত অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন যেমন থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের রক্তশূন্যতা থাকে। কোনো কারণে রক্তক্ষরণ হলেও রক্তশূন্যতা হবে। এই রক্তক্ষরণ অনেক সময় চোখে না-ও দেখা যেতে পারে, যেমন পেপটিক আলসার বা অন্ত্রের কোনো ঘা বা ক্যানসার থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে নীরবে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন টিবি, কিডনি ও যকৃতের জটিলতা, ভিটামিন বি১২ ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব, থাইরয়েডের সমস্যা, অস্থিমজ্জার সমস্যা, কেমোথেরাপি, ক্যানসার ইত্যাদি নানা সমস্যায় রক্তশূন্যতা হয়। তাই রক্তশূন্যতার সঠিক কারণটি নির্ণয় না করে শুধু আয়রন বড়ি খেয়ে লাভ না-ও হতে পারে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন থ্যালাসেমিয়ায় আয়রন বড়ি খাওয়া বিপজ্জনক।
লৌহের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতায়
এটা ঠিক যে রক্তশূন্যতার সব ধরনের কারণের মধ্যে আমাদের দেশে আয়রন বা লৌহের ঘাটতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ঘাটতি যে সব সময় খাদ্যতালিকায় লৌহের অভাবে হয়, তা নয়। শিশুদের কৃমি এ ধরনের রক্তশূন্যতার একটি বড় ঝুঁকি। আমাদের দেশে শিশুর পুষ্টির এক-তৃতীয়াংশ কৃমি ধ্বংস করে ফেলে। তাই শিশু ও বয়স্ক সবারই নিয়মিত কৃমি প্রতিরোধক ওষুধ সেবন করা উচিত। মেয়েদের মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, গর্ভাবস্থায় ও স্তন্যদানকালে আয়রনের ঘাটতি হয়। এ সময় প্রচুর আয়রনসমৃদ্ধ খাবার ও প্রয়োজনে আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে। পাতাবহুল সবুজ শাকসবজি, লাল মাংস, কলিজা, বীজজাতীয় খাদ্য ইত্যাদিতে আয়রন আছে। অতিরিক্ত চা, কফি, দুধ, অ্যান্টাসিড অন্ত্রে আয়রন শোষণে বাধা দেয়। আয়রনসমৃদ্ধ খাবার বা বড়ি খাবার সময় এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
ডা. মৌসুমী মরিয়ম সুলতানা
মেডিসিন বিভাগ, ইউনাইটেড হাসপাতাল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৭, ২০১৩
Leave a Reply