রেকটাম বা মলাশয় ক্যান্সার হলে প্রচলিত অপারেশন হচ্ছে রেকটাম বা মলাশয় ও মলদ্বার কেটে ফেলে পেটে Colostomy বা কৃত্রিম মলদ্বার বানিয়ে সেখানে ব্যাগ লাগিয়ে দেয়া, যার মধ্যে সব সময় মল জমা হবে এবং রোগী মাঝে মধ্যে এটি পরিষ্কার করে নেবেন। তার স্বাভাবিক মলদ্বার থাকবে না এবং সারা জীবন ওই পথে আর পায়খানা হবে না। কিন্তু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ফলে এখন স্বাভাবিক মলদ্বার রেখেই ক্যান্সারটি অপসারণ করা যায়। রোগী স্বাভাবিক পথেই পায়খানা করতে পারবেন। এ প্রযুক্তির ফলে ৭০-৮০% রেকটাম ক্যান্সার রোগী উপকৃত হবেন।
লক্ষণ কী?
মলদ্বারের দৈর্ঘ্য ৪ সেমি। মলদ্বারের ওপরের ১২ সেমি অংশের নাম রেকটাম। মলদ্বারে রক্ত যাওয়া এ রোগের প্রধান লক্ষণ। এ লক্ষণটিকে রোগীরা আমল দেন না। রোগী যদি এই রক্ত যাওয়ার কারণ ডাক্তার দিয়ে পুরোপুরি তদন্ত না করেই সিদ্ধান্ত নেন, এটি পাইলস থেকে হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপদটি তখনই ঘটে। এরপর মাসের পর মাস কেটে যায় পাইলস মনে করে। ইত্যবসরে ক্যান্সার তার ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। পেটে ব্যথা হতে থাকে, মল আটকে গিয়ে পেট ফুলে উঠতে পারে। তখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে বিশেষ ধরনের পরীক্ষায় এ রোগ ধরা পড়ে। ততক্ষণে এ রোগটি সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
প্রথম দিকে রোগীর মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন আসে। মলত্যাগের বেগ হলে রোগী টয়লেটে যান এবং শুধু রক্ত ও মিউকাস যেতে দেখেন। এটি সাধারণত ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে হয়। রোগীরা এটিকে রক্ত আমাশয় বলে ধারণা করেন। ক্যান্সার যখন মলদ্বারের দিকে সম্প্রসারিত হয় তখন মলত্যাগের পর ব্যথা শুরু হয়ে দীর্ঘক্ষণ চলতে পারে। রোগীদের যখন বলা হয় আপনাকে বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কোনো ক্যান্সার আছে কি না। তখন তারা বলেন, স্যার আমি জানি এটি পাইলস। অনেক বছর ধরে চলছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যে এখানে ক্যান্সার শুরু হতে পারে তা তারা খতিয়ে দেখতে চান না। সবচেয়ে অসুবিধা হলো পাইলস, ক্যান্সার, এনালফিশার সব রোগে রক্ত যাওয়াই প্রধান লক্ষণ। আসলে কোন রোগটি হয়েছে তা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে একজন অভিজ্ঞ সার্জনই কেবল বলতে পারেন। এই ক্যান্সার যদি মূত্রথলি অথবা মূত্রনালী আক্রমণ করে তখন রোগী প্রস্রাবের কষ্টে ভোগেন এবং বারবার প্রস্রাব হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার যৌনপথে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ওই পথ দিয়ে রক্ত ও মিউকাস এমনকি মলও বেরিয়ে আসতে পারে।
বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা
মলের সুপ্ত রক্ত পরীক্ষা, মলদ্বারের ভেতর আঙুল দিয়ে পরীক্ষা, প্রকটসিগময়ডোস্কপি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোলোনস্কপি, বেরিয়াম এনেমা, সি-ই-এ (কার্সিনো এম্রাইওনিক এন্টিজেন), আল্ট্রাসনোগ্রাম অব লিভার, আইভিইউ এক্স-রে, পেটের সিটি স্ক্যান
প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি ও অত্যাধুনিক চিকিৎসা
অপারেশনই এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা। এ রোগে ঐতিহ্যবাহী অপারেশন হচ্ছে রেকটাম বা মলাশয় ও মলদ্বার কেটে ফেলে পেটে নাভীর বাম দিকে কলোস্টমি বা কৃত্রিম মলদ্বার তৈরি করে দেয়া। যেখানে একটি ব্যাগ লাগানো থাকে, যার ভেতর মল জমা হতে থাকে। যখন রোগীকে এ জাতীয় অপারেশনের ধারণা দেয়া হয় তখন অনেক রোগীই বলেন, স্যার মরে যাব তবুও এমন অপারেশন করাব না। এসব রোগী এরপর হাতুড়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন অপারেশন ছাড়াই চিকিৎসার জন্য। কিছু দিন চিকিৎসার পর হতাশ হয়ে যখন ফিরে আসেন তখন সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলার অবস্থা আর থাকে না। তখন রোগী মিনতি করে বলেন, স্যার ভুল হয়ে গেছে এখন কিছু একটা করুন।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আমরা ৭০-৮০% রেকটাম ক্যান্সার রোগীর মলদ্বার না কেটেই অপারেশন করতে পারি। যার ফলে স্বাভাবিক পথেই পায়খানা করতে পারবেন। এ প্রযুক্তিটির নাম হচ্ছে Stapling Technique (Disposable Circular Stapler, Proximate ILS, Proximate Linear Stapler I Roticulator)। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ আমি দেশের ঐতিহ্যবাহী হাসপাতাল হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে এ রকম একটি জটিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সফল অপারেশন করেছি। অপারেশনটি করতে আমাকে আমন্ত্রণ জানান দেশের প্রখ্যাত সার্জন ও আমাদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ডা. জিয়াউল হক। রোগীর বয়স ৫০। বাংলাদেশ বিমানের অফিসার। অনেক দিন মলদ্বারে রক্ত যাচ্ছিল। হঠাৎ পেট ফুলে যাওয়ায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করে এই ক্যান্সারটি শনাক্ত করেন ডা. জিয়াউল হক। এ অপারেশনের জন্য একবার ব্যবহারযোগ্য দু’টি যন্ত্র আমরা সিঙ্গাপুর থেকে এনেছিলাম আগেভাগেই। যন্ত্রটি কিছুটা ব্যয়বহুল। অপারেশনের সময় আমরা বৃহদান্ত্র ও রেকটামের নির্ধারিত অংশটুকু কেটে ফেলে এই যন্ত্রের সাহায্যে বৃহদান্ত্র ও রেকটামের অবশিষ্টাংশ সংযুক্ত করে দিই। তলপেটের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এই যন্ত্র ছাড়া এ জাতীয় অপারেশন করা প্রায় অসম্ভব। বিগত নয় বছর আমরা এ জাতীয় অত্যাধুনিক অপারেশন অনেক করেছি। এ অপারেশনের পর সাধারণত পেটে অস্থায়ী ভিত্তিতে দু-তিন মাসের জন্য একটি ব্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়। তিন মাস পর ওই ব্যাগটি (কলোস্টমি বা আইলিওস্টমি) আবার অপারেশন করে বন্ধ করে দিতে হয়। তখন রোগী স্বাভাবিক মলদ্বার দিয়ে মলত্যাগ করতে পারেন। যখন রেকটামের ক্যান্সার খুবই গভীর থাকে তখন হাত দিয়ে সেলাই করে খাদ্যনালী জোড়া লাগানো যায় বলে এই যন্ত্র ব্যবহার প্রয়োজন হয় না।
রেকটাম ক্যান্সার কেন হয়?
ধনী লোকদের এ রোগ বেশি হয়। মদ্যপান ও ধূমপান এর সম্ভাবনা বাড়ায়। খাবারে যথেষ্ট আঁশ জাতীয় উপাদান থাকলে, যেমন সবজি, ফলমূল এ রোগের সম্ভাবনা কমায়। ৪০ বছর বয়সের পর এই সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
——————————–
অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক
লেখকঃ বৃহদান্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ
চেয়ারম্যান, কলোরেকটাল সার্জারি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চেম্বারঃ জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ৫৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা।
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৭ এপ্রিল ২০০৮
Leave a Reply