জরায়ুমুখের ক্যানসার
খুব ধীরে ধীরে সৃষ্টি হওয়া এক রোগ। এক যুগের বেশি সময় ধরে জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষ পরিবর্তিত হতে থাকে। একসময় তা ক্যানসারে রূপ নেয়। ক্যানসার কোষ দ্রুত বাড়তে থাকে, পিণ্ডের আকার বেড়ে যায়, জরায়ুমুখে ক্ষত সৃষ্টি করে। এতে রক্তক্ষরণ হয়, বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিভিন্ন রকম উপসর্গ দেখা দেয়। একসময় তা দূরের অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। রোগ আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না।
এ রোগে আক্রান্ত নারীরা সাধারণত ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী হয়ে থাকেন। ২০ বছরের নিচে এ রোগ হয় না।
৬০ বছরের পরও এ রোগ হতে পারে, তবে তাঁদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। এমনকি শারীরিক পরীক্ষা করেও তেমন চিহ্ন বা ক্ষত চোখে দেখা যায় না। জরায়ুমুখের ক্যানসার খুব ধীরগতিতে সৃষ্টি হওয়ায় খুব সহজেই এবং কম খরচে ক্যানসার-পূর্ব অবস্থায় রোগ শনাক্ত করা যায়। উপযুক্ত চিকিৎসায় এ রোগ শত ভাগ নিরাময় করা যায়।
তবে আশার কথা হলো, এ রোগের কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে। তা হলো:
অল্প বয়সে বিয়ে বা শারীরিক মিলনসম্পর্ক করা, একাধিক বিয়ে বা একাধিক শারীরিক মিলনসাথি,
ঘন ঘন সন্তানধারণ,
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপায়ী, পানের সঙ্গে তামাক পাতা বা জর্দা খাওয়া, দাঁতের গোড়ায় তামাক পাতার গুঁড়া (গুল) ব্যবহার
হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসের আক্রমণ।
এ ছাড়া অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা, পুষ্টিহীনতা ও দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন (টানা ১০-১২ বছরের অধিক সময়) এ রোগের কারণ হিসেবে কোনো কোনো গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
উন্নত দেশে এ রোগের প্রকোপ অনেক কমে এসেছে এবং এ রোগজনিত মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। নারীশিক্ষার প্রসার, উন্নত জীবনযাপন, স্বাস্থ্যসচেতনতা, সর্বোপরি যুগান্তকারী ‘পেপস স্মেয়ার টেস্ট’ আবিষ্কার এ রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়। আমেরিকার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৫৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় জরায়ুমুখের ক্যানসারজনিত মৃত্যু ৭৫% কমে গেছে। প্রতিবছর ২% হারে মৃত্যু কমে আসছে। যে দেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের হার যত কম, সে দেশ তত উন্নত। এটি উন্নতির একটি সূচকও বটে।
পেপস স্মেয়ার টেস্ট
এটি একটি সহজ পরীক্ষা। জরায়ুমুখ থেকে রস নিয়ে আণুবীক্ষণিক (মাইক্রোস্কোপিক) যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা। এ পরীক্ষা দিয়ে ক্যানসার, ক্যানসার হওয়ার পূর্বাবস্থা ও জরায়ুমুখের অন্যান্য রোগ, যেমন প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) শনাক্ত করা যায়। এতে কোনো ব্যথা হয় না। এ টেস্টের খরচও কম। সাধারণত বিবাহিত নারীদের ২১ বছরের পর থেকে এ টেস্ট শুরু করা যেতে পারে; ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি তিন বছর পর পর এ টেস্ট করা উচিত। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে এ রুটিনের পরিবর্তন হতে পারে।
হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)
প্রায় দুই দশক আগে জরায়ুমুখের ক্যানসারের সঙ্গে হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি যোগসূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। জরায়ুমুখের ক্যানসার একটি অন্যতম প্রধান কারণ (শতকরা ৭০ ভাগ)। তবে একমাত্র কারণ নয়। শারীরিক মিলন সংযোগে এর সংক্রমণ ঘটে। এযাবৎ ১০০ ধরনের এইচপিভি শনাক্ত হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই (৭০%) জরায়ু ক্যানসারের জন্য তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে জরায়ু ক্যানসারের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি শনাক্ত হয়েছে। এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসের আক্রমণ হলেই যে ক্যানসারের সৃষ্টি হয়, তা নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীদের জরায়ু প্রায়ই এইচপিভি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এতে কোনো উপসর্গ থাকে না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাবলে ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে জরায়ু প্রায় সব এইচপিভিমুক্ত হয়ে যায়। কেবল জরায়ুতে এইচপিভি দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে, জরায়ু কোষে পরিবর্তনের সূচনা করে। অতি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি আক্রান্ত হলে জরায়ুমুখ, জরায়ুপথ, পায়ুপথ এবং সংলগ্ন স্থানে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। যেসব বিষয় জরায়ুতে এইচপিভির স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়, তা হলো, ধূমপান ও তামাক পাতার ব্যবহার যেমন: পানের জর্দা, সাদা পাতা খাওয়া, গুল ব্যবহার, দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন অপুষ্টি, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, এইডস, জরায়ুতে অন্যান্য ইনফেকশন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
এইচপিভি আক্রান্ত হয়েছে কি না, তা জানার জন্য জরায়ুমুখ থেকে রস নিয়ে ডিএনএ টেস্ট করে এইচপিভি শনাক্ত করা যায়। এইচপিভি টেস্ট করার আগে অবশ্যই পেপস টেস্ট করা হয়। জরায়ু ক্যানসারের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের এ টেস্ট করা হয়। এইচপিভি টেস্ট করার জন্য আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন আছে। ৩০ বছরের কম বয়সী নারীদের এ টেস্ট করা হয় না। কারণ, কম বয়সীরা প্রায়ই এইচপিভি আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং স্বাভাবিক নিয়মে শরীর ভাইরাস মুক্ত হয়ে যায়। এইচপিভি টেস্ট তাদের অহেতুক ভীতির সৃষ্টি করতে পারে।
জরায়ু ক্যানসারের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ নারী, পেপস টেস্ট অস্বাভাবিক ((ডিসপ্লসিয়া), একই সঙ্গে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি আক্রান্ত, তাকে অবশ্যই এ রোগ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য কল্পোস্কোপি (একধরনের যন্ত্র, যা দিয়ে জরায়ুমুখ ৪ থেকে ২৫ গুণ বড় করে দেখা যায়) দ্বারা জরায়ুমুখ ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়, যাতে ক্যানসার-পূর্ব অবস্থায় রোগ শনাক্ত করা হয়। সাধারণভাবে এইচপিভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোনো চিকিৎসা নেই এবং চিকিৎসার কোনো প্রয়োজন হয় না। যদি জরায়ুতে কোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার বিভিন্ন রকম পদ্ধতি আছে।
পুনঃপুন পরীক্ষা করে দেখা। শুধু লক্ষ রাখা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে জরায়ুমুখের অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ক্রায়োথেরাপি: যন্ত্রের সাহায্যে অতি ঠান্ডা করে জরায়ুমুখের আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা হয়।
লিপ: ইলেকট্রিক যন্ত্রের সাহায্যে জরায়ুমুখের আক্রান্ত কোষ কেটে ফেলা হয়।
এইচপিভির প্রতিরোধ
কার্যকর প্রতিরোধ হলো এইচপিভি টিকা নেওয়া। এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১-এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ টিকা নেওয়া হলে শরীরে উল্লিখিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়। জরায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডি তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়।
দুই ধরনের টিকা আছে। একটি (সারভারিক্স) দুিট ভাইরাসের (এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮) প্রতিরোধক টিকা, অপরটি (গার্ডাসিল) চারটি ভাইরাসের প্রতিরোধক টিকা।
যেকোনো একধরনের টিকা (সারভারিক্স অথবা গার্ডাসিল) ১২-১৩ বছরের বালিকাদের এইচপিভি আক্রান্ত হওয়ার আগে দেওয়া হয়। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) নিয়মানুযায়ী, ৯ থেকে ২৫ বছর বয়সে এ টিকা কার্যকর হয়। তিনটি ডোজ দিয়ে এ টিকা থাকে। প্রথম ডোজ নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়। টিকা নেওয়ার পরমুহূর্ত থেকে চার থেকে ছয় বছর এ টিকা কার্যকর থাকে বলে বর্তমানে গণ্য করা হয়। তবে বিবাহিত জীবনযাপনের এ টিকা তেমন কার্যকর হয় না।
গর্ভাবস্থায় এ টিকা নেওয়া এখনো অনুমোদিত হয়নি।
এইচভিপি ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার পর বা ক্যানসার হয়ে যাওয়ার পর টিকা দিলে কোনো কাজে আসে না। কারণ, এ টিকা ইনফেকশন দমন করতে পারে না এবং ক্যানসারের গতি রুদ্ধ করতে পারে না। এ টিকা গ্রহণকারীকেও নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নিতে হবে।
সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা। সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলা।
মেলামেশায় প্রোটেকশন ব্যবহার করা।
জরায়ুমুখের ক্যানসার আজও বাংলাদেশের নারীদের ১ নম্বর সমস্যা। মহিলা ক্যানসার রোগীদের শতকরা ২৫ ভাগ অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন এ রোগে আক্রান্ত। এ রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনার জন্য নারীদের এ রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন (মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর) মেনে চলা।
অধিক সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা।
ধূমপান বন্ধ করতে হবে। অন্যের ধূমপানে যাতে নিজের ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে অর্থাৎ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার না হওয়া।
বন্ধ করতে হবে পানের সঙ্গে জর্দা ও সাদা পাতা খাওয়া ও দাঁতের গোড়ায় গুল (তামাকের গুঁড়া) লাগানো।
সুষম খাবার খেতে হবে, যাতে পুষ্টি ঘাটতি না থাকে। প্রতিদিন তিন থেকে চার বার ফল, শাকসবজি ও তরকারি খেতে হবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করা। সামাজিক অনুশাসন মেনে চলা।
নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নেওয়া
সময়মতো এইচপিভি টিকা নেওয়া।
উল্লিখিত বিষয়গুলো বেশি বেশি করে প্রচার করে এবং ঘরে ঘরে এসব তথ্য পৌঁছে দিতে পারলে উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও জরায়ুমুখের ক্যানসার এবং এ ক্যানসারজনিত মৃত্যুর হার উল্লেযোগ্যভাবে কমে আসবে।
পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩
mrinmay
thanks for these……………..