পড়ন্ত শীতের বিকেলে ঢাকার ক্রিকেট মাঠে টান টান উত্তেজনা। প্রখ্যাত ক্রিকেটার রমন লাম্বা হেলমেট ছাড়া ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করছেন। কিন্তু মুহূর্তেই এ কী হলো! পরের বিয়োগান্ত ঘটনা বিশ্ববাসী জানে। মনে প্রশ্ন আসে, হেলমেট কী, কীভাবে এই বন্ধু বিপদের সময় পাশে দাঁড়ায়।
ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে প্রাচীন যুগের অশিরিয়ান যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দানে মাথায় চামড়া অথবা ধাতুর তৈরি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করতেন। কালক্রমে শিরস্ত্রাণ পরিণত হয়েছে আজকের দিনের হেলমেটে, যা সভ্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, চলার পথের সাথি। প্রখ্যাত সমরনায়ক লরেন্স অব অ্যারাবিয়া মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্টে মারাত্মকভাবে মাথায় আঘাত পেয়ে ১৯৩৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তরুণ নিউরোসার্জন হিউ কেয়ার্ন তাঁর চিকিৎসা করার সময় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন ক্রাস হেলমেট।
হেলমেট কীভাবে কাজ করে, এটা বোঝার জন্য আসুন একটু জানতে চেষ্টা করি মাথায় আঘাতে মস্তিষ্ক কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
আঘাতের ফলে মস্তিষ্কের সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাকে ‘কু’ বলে। একই সময়ে বিপরীত পাশের মস্তিষ্ক খুলির হাড়ের ভেতরের দিকের সঙ্গে বা আরও ভেতরের ডুরা মেটারের পর্দার ভাঁজের সঙ্গে আঘাত লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যাকে ‘কন্ট্রা কু’ বলা হয়। আঘাতের কারণে কু এবং কন্ট্রা কু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, কন্টিউশান (ঘষা লাগা), লেসারেশন (ছিলে যাওয়া), হেমোরেজ (রক্তক্ষরণ), বিস্তৃত এলাকায় ঝাঁকুনিতে কনকাশন (সাময়িকভাবে অজ্ঞান) এবং ডিফিউজ অ্যাংনাল ইনজুরি (অনেকখানি জায়গার স্নায়ুকোষের ক্ষতি) হতে পারে। থেমে থাকা গাড়ি হঠাৎ দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করায় ঘুমন্ত যাত্রীর মস্তিষ্ক আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে, যাকে অ্যাকসিলারেশন বলা হয়। আবার দ্রুতবেগে চলন্ত গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করায় ডিকসিলারেশন জাতীয় আঘাত লাগতে পারে। মোটরসাইকেলের আরোহী ছিটকে পড়ে গতিশীল মাথা রাস্তা, দেয়াল বা গাছের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ইমপ্যাক্ট আঘাত পেতে পারে। অথবা গতিশীল বস্তু যেমন: লাঠির বাড়ি, ছুড়ে দেওয়া ইটের টুকরা বা ছাদ থেকে পড়া ফুলের টব দিয়েও মাথায় আঘাত লাগতে পারে।
এসব বিষয়ে খেয়াল রেখে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক হেলমেট, যা মস্তিষ্ককে দুইভাবে রক্ষা করে। প্রথমত, ধারালো কিছু মাথার ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। দ্বিতীয়ত, মাথাকে রাস্তা বা অন্য বস্তুর সঙ্গে ঘষা খাওয়া থেকে বাঁচায় এবং আঘাতের সম্ভাব্য ডিকসিলারেশন ইনজুরির মাত্রা কমিয়ে দেয়। এ কারণে একটি ভালো হেলমেটের ভেতরের দিকের ফোমের লাইনিং মসৃণ এবং কোমল হওয়া আবশ্যক। হেলমেট ডিজাইন করার সময় চলার গতি ও বাইরের বাতাসের সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি লক্ষ রাখা হয়, যাতে করে জমে থাকা ঘাম সহজেই বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। হেলমেটে চোখের দিকে লাগানো কাচকে বলে ভিজর, যা দুই চোখকে বাইরের বাতাস, ধুলাবালি, কীটপতঙ্গের আঘাত থেকে রক্ষা করে। সাধারণত সিনথেটিক ফাইবার দ্বারা আধুনিক সময়ের হেলমেট তৈরি করা হয়। ফরাসি নিউরোসার্জন ডা. ওভরিজা লক্ষ করেছিলেন, প্রচলিত হেলমেট পরা সত্ত্বেও দুর্ঘটনার সময় মানুষের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এর বায়োমেকানিক্যাল দিক গবেষণা করে তিনি অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত ‘বায়োস’ নামে নতুন হেলমেট উদ্ভাবন করেন। মস্তিষ্কের গঠন, মাথায় আঘাত, বায়োমেকানিক প্রভৃতিকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বায়োস হেলমেটের আঘাত প্রতিরোধী ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এই হেলমেট সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। হেলমেট ব্যবহারে মাথায় আঘাতের হার শতকরা ৬৯ ভাগ কমে, ফলে মৃত্যুহার কমে ৪২ ভাগ।
যদিও ব্যবহারকারীদের মধ্যে কালো হেলমেটের জনপ্রিয়তা বেশি। তবে সাদা বা ভালোভাবে দেখা যায় এমন হেলমেট দুর্ঘটনা কমায়। আলো প্রতিফলিত হয় এমন হেলমেট না পরা ভালো, কারণ এতে অন্য গাড়িচালকের অসুবিধা হতে পারে।
কখন পরা উচিত?
রাস্তায় চলার সময়, বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালানোর সময়, এ ছাড়া কনস্ট্রাকশনে কাজ করার সময়, ফায়ার ব্রিগেডে কাজ করার সময়, পেশাগত কাজ করার সময়, ঘোড়দৌড়ের সময়, বরফের ওপর হকি খেলার সময়, বেসবল খেলার সময়, আমেরিকান ফুটবল খেলার সময়, পাহাড়ে ওঠার সময়, খনির ভেতরে কাজ করার সময় হেলমেট ব্যবহার করা উচিত। ক্রিকেট খেলার সময়ও হেলমেট ব্যবহূত হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আইন অনুযায়ী, একজন মোটরসাইকেলের চালক তাঁর গাড়িতে একজন সহযাত্রী নিতে পারেন, তবে চালক ও সহযাত্রীকে অবশ্যই হেলমেট পরতে হবে। ১৯৮২ সালের মোটরযান অধ্যাদেশের ১৩৭ ধারা মোতাবেক মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট না পরার জন্য ২০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সুপ্রিয় পাঠক, আসুন প্রয়োজনীয় মুহূর্তে নিজে হেলমেট পরি ও অন্যকে পরতে উৎসাহিত করি।
সুদিপ্ত কুমার মুখার্জী
নিউরোসার্জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩
Leave a Reply