দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিল
তাঁর দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ভরা জীবন ছিল। জীবনভর সংগ্রাম ছিল। আর এমন একটা জিনিস ছিল, যা আমাদের অনেকেরই নেই, থাকে না—‘কমিটমেন্ট’। মাত্র ৪৬ বছর বয়সী এক স্বপ্নবান ডাক্তারের গল্পের মতো অপ্রত্যাশিত অকালপ্রয়াণ এবং মানুষের জন্য ‘কমিটমেন্ট’-এর সত্য কাহিনি শোনানোর জন্যই আমার অশ্রুসিক্ত কলম চলছে আজ। প্রিয় পাঠক, আসুন, সেই মানবদরদি ডাক্তারের অল্প কিছু কথা জানি।
দেলদুয়ারের গাঁয়ের ছেলে
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের হিংগানগর গ্রামের ছেলে শিশির। তিন ভাই পাঁচ বোনের দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট সংসারে ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। পায়ে হেঁটে দূরের স্কুল আর সাইকেলে টাঙ্গাইলের কলেজ পেরিয়ে ১৯৮৫ সালে সুযোগ পান মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার। শুরু হয় বাবুল চন্দ্র দের ডাক্তার হওয়ার গল্প।
ময়মনসিংহের সংগ্রামী জীবন
পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য ছিল না ছেলেকে হোস্টেলে রেখে মেডিকেলে পড়ানোর। ছেলে তো দমার পাত্র নন। টিউশনি করে, কোচিংয়ে পড়িয়ে নিজের খরচ নিজেই চালান আবার খরচ বাঁচিয়ে বাবা-মায়ের সংসারেও দেন। বাবা-ভাই কৃষি কাজ করেন, জমিতে সার লাগবে, বোনের বিয়ে, পুজোর কাপড়—সব কিছুরই জোগান দেন মেডিকেল ছাত্র।
সন্ধানীময় জীবন
নিজের পড়াশোনা, ছাত্রছাত্রী পড়ানো, রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়া দৈনন্দিন রুটিন। সচেতন ছিলেন, ছাত্ররাজনীতির পঙ্কিলতা ভালো লাগল না, তাই জড়ালেন মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সন্ধানীর সঙ্গে। নিজে রক্ত দিয়েছেন ২৫ বারের বেশি (আমার জানা মতে)। ১৯৮৬ সাল থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদানের আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
মানবতাবাদী ডাক্তার
১৯৯২ সালে স্বপ্নপূরণ। ডাক্তার হলেন। হলেন সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির ময়মনসিংহ জোনের সাধারণ সম্পাদক। কখনোই ভোলেননি শিকড়ের কথা। নিজের গ্রামের মানুষের কাছে তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ‘ডাক্তারবাবু’। টাঙ্গাইলের নিজের এলাকায় মানুষজন অসুখ-বিসুখে চলে আসতেন ময়মনসিংহে—তাঁদের দেখভাল, চিকিৎসা, ওষুধপত্র, কারও রক্ত লাগলে—সব ভরসা শিশিরবাবু। ‘মরণোত্তর চক্ষুদানে কোনো ধর্মেই বাধা নেই’—বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমিনার সংগঠক ছিলেন, মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছিলেন ছাত্রজীবনেই।
মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ
বাংলাদেশে মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব নিরাময়ে পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি। মানুষকে বোঝানো এবং মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করানো খুবই দুরূহ কাজ। কর্নিয়া সংগ্রহ করা আরও দুরূহ। মৃত্যুর ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হয়। অঙ্গীকার করলেও সব সময় কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না আত্মীয়স্বজন সহযোগিতা না করলে। তাই হাসপাতালের বেওয়ারিশ মরদেহ থেকেই কর্নিয়া সংগৃহীত হয় বেশি। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর আত্মীয়স্বজনকে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রণোদিত করে মৃত্যুর পর কর্নিয়া সংগ্রহ করার দুরূহতম মহৎ কাজটি করতে প্রথম সক্ষম হয়েছিলেন ডা. শিশির। আবার ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধ্যাপক আভা হোসেনের প্রথম কর্নিয়া সংযোজনের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন তিনি। সিনেমা হলের টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে সন্ধানী লটারির আয়োজন—সবকিছুতেই তাঁর অবদান ছিল। আমরা কি কেউ ভেবেছিলাম, মানুষের চোখ চেয়ে চেয়ে অসময়ে নিজের দুই চোখ তিনি দিয়ে যাবেন— ‘কমিটমেন্ট’ রক্ষা করার জন্য!
দুই নয়নের মণি
তাঁর দুই কন্যা জয়িতা (১২) আর অর্চিতা (৭), তাঁর দুই নয়নের মণি। নিজে সারা জীবন কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হয়েছেন, ছুটির দিনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গেছেন প্র্যাকটিস করতে—স্বপ্ন ছিল দুই কন্যাকে নিজের মতো ‘মানুষ’ করবেন—ওদের যেন কোনো কষ্ট না হয়। ইচ্ছে ছিল নিজের গ্রামে একটি ছোট হাসপাতাল করে গ্রামের নারীদের চিকিৎসাসেবা দেবেন। মেয়েদের নিয়ে স্কুলের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন কক্সবাজার—ফিরলেন ২ জানুয়ারি ভোরে—বাসায় ঢুকে হঠাৎ বুকে ব্যথা, ঢলে পড়লেন। চিকিৎসার সুযোগও দিলেন না, যেন সমুদ্রস্নান সেরে পবিত্রযাত্রা করলেন পরপারে।
…স্বপ্ন দেখব বলে দুচোখ মেলেছি
মরদেহ ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইলে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল। স্ত্রী, কন্যাসহ নিকটাত্মীয়রা বসে আছেন পরিচালকের কক্ষে, আর তাঁকে নিয়ে আমরা চক্ষু অস্ত্রোপচার কক্ষে। সন্ধানীর আমরা কজন তাঁর কর্নিয়া দুটো সংগ্রহ করব। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির ‘আই ব্যাংক সমন্বয়কারী’ নিপুণভাবে কর্নিয়া সংগ্রহ করছেন—আমরা পাশে দাঁড়িয়ে। শিশির দা কি শেষবারের মতো তাকালেন? বললেন, স্বপ্ন দেখব বলে দুচোখ মেলেছি… আহ্ কী কষ্ট!
পরদিন ঢাকায় তাঁর কর্নিয়া দুটো প্রতিস্থাপিত হয়েছে—দুজন অপরিচিত মানুষের চোখে। এই দুজন মানুষ এখন এই পৃথিবীকে দেখবেন তাঁর দুই কর্নিয়া দিয়ে।
শুধু ধন্যবাদ নয়, বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর মা, স্ত্রী, কন্যাদ্বয় এবং ভাইবোনদের প্রতি। তাঁর অঙ্গীকার পূরণে সক্রিয় সহযোগিতার জন্য।
আসুন ডা. শিশিরের মতো আমরাও মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করি। আর তাঁর পরিবারের মতো সেই অঙ্গীকার পূরণে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসি।
আমাদেরও দায়িত্ব আছে…তাই স্বপ্ন দেখব বলে দুহাত পেতেছি
সারা জীবন কষ্ট করে যখন একটু সুখের মুখ দেখতে শুরু করলেন, বিধাতা তখনই তাঁকে নিয়ে গেলেন। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে তাঁর গৃহলক্ষ্মী স্ত্রী আবারও কষ্টযাত্রা শুরু করবেন? দেশ-বিদেশে কত হূদয়বান, সামর্থ্যবান মানুষ আছেন—আমরা বিশাল সন্ধানী পরিবার আছি—দুই কন্যার লেখাপড়া, ভরণপোষণের জন্য আমাদের, সমাজের কি কোনোই দায়িত্ব নেই? আসুন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই, দায়িত্ব পালন করি। তিনি কিন্তু দেখবেন দিব্যচোখে, তাঁর চোখের মণিদুটো বেঁচে থাকবে চোখের আলোয়।
(ডা. বাবুল চন্দ্র দে তহবিলে সহযোগিতা করতে চাইলে যোগাযোগ করুন সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি, ৮৬১৪০৪০ নম্বরে, ই-মেইল করুন [email protected]; অথবা [email protected])
ডা. ইকবাল কবীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারি ০৯, ২০১৩
Leave a Reply