মানসিক রোগ এমনই একটি রোগ যে রোগে জীবনের কোন না কোন সময়ে আমরা যে কেউ আক্রান্ত হতে পারি। তাই বিভিন্ন মানসিক রোগ সর্ম্পকে আমদের প্রত্যেকেরই ধারণা থাকা উচিত।
মানসিক রোগ মূলত দুই প্রকার। যেমন
(১) নিউরোসিস এবং (২) সাইকোসিস।
নিউরোসিস রোগটি মৃদু ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগির আচার-আচরণ বা ব্যবহারে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। এই নিউরোসিস জাতীয় রোগে রোগী নিজে রোগটিতে ভূগতে থাকে ও কষ্ট পেতে থাকে এবং মানসিক রোগ সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে অনেক রোগীই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান না। আর সাইকোসিস রোগটি হচ্ছে জটিল ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর আচার-আচরণ বা ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কুসংস্কার এবং মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে এক্ষেত্রেও অধিকাংশ রোগীর অভিভাবক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান না। এরা একে পরী ধরা, জ্বিনের আছর, ভূতে ধরা, বাতাস লাগা, প্রভৃতি মনে করে পানি পড়া, তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদির জন্য পীর, ফকির, দরবেশের কাছে ছুঁটে যান। এতে করে রোগীর তো কোন উপশম হয়ই না বরং বিভিন্ন অপচিকিৎসায় রোগীর অবস্থা আরো জটিল আকার ধারণ করে।
বিভিন্ন নিউরোসিস মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছেঃ
টেনশন বা উদ্বেগ আধিক্য রোগ
মানুষ মাত্রই টেনশন থাকে। কিন্তু টেশনের এই স্বাভাবিক মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যায় তখনই এ রোগ হয়। এ রোগে একটা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে বাস করে রোগী এবং কাজে কর্মে মন বসাতে পারে না।
অবসেশল বা শুচিবায়ু রোগ
এ রোগটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তি একই কাজ বার বার করে। যেমন-হাত ধোয়া, ঘরের তালা লাগানো ঠিক মতো হলো কিনা সেটা বার বার চেক করা, একটা চিন্তা মাথায় ঢুকলে সে চিন্তাই বার বার করা। বার বার একই কাজ করতে রোগী নিজেকে বাধা দিতে চায়। কিন্তু পারে না।
হিস্টিরিয়া
মহিলারা এ রোগটিতে বেশি আক্রান্ত হয়। দুশ্চিন্তাই এ রোগের মূল কারণ। রোগী যখন তার দুশ্চিন্তার কথা মুখে প্রকাশ করতে পারে না তখন শারীরিক বা মানসিক উপসর্গের মাধ্যমে এ রোগ প্রকাশ পায়।
ফোবিয়া বা অহেতুক ভীতি রোগ
অহেতুক ভীতি বা ফোবিয়া সেটাই যেখানে যতটুকু ভয় পাওয়ার প্রায়োজন তার অত্যন্ত বেশি ভীত হয়ে পড়া। উদাহরণ স্বরুপ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষ করে কেউ মারা গেছে শুনলে, বেতার বা টিভিতে খুন জখমের কথা শুনলে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে। এছাড়া নিউরোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে ধাতুগত রোগ, শরীর নিয়ে রোগ (হাইপো-কনড্রিয়াসিস) ইত্যাদি।
বিভিন্ন সাইকোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে।
ডিপ্রেমন বা বিণ্নতা রোগ
বিষণ্নতা বোধ এবং বিষণ্নতা রোগ দুটি আলাদা জিনিস, সত্যিকার বিষন্নতা রোগে মন খারাপ ভাব দীর্ঘমেয়াদী ভাবে থাকবে যা রোগী ইচ্ছা শক্তি দিয়েও দূর করতে পারে না এবং তার কাজ-কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। যেমন- দীর্ঘমেয়াদী অশান্তি বোধ, আনন্দদায়ক কাজে আনন্দ না পাওয়া, আত্নহত্যার চিন্তা করা প্রভৃতি।
সিজোফ্রেনিয়া
সিজোফ্রেনিয়া মানসিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল ব্যাধি। এ রোগের বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে পরিবেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা অসংলগ্ন এলোমেলো ও হেঁয়ালি পূর্ণ কথাবার্তা বলে, কানে গায়েবী আওয়াজ শোনা ইত্যাদি। আরো সাইকোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে ম্যানিয়া, প্রসবোত্তর মানসিক ব্যাধি। ম্যানিক ডিপ্রেসিভ রোগ প্রভৃতি।
এছাড়াও আছে শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগঃ
আমরা অনেকেই জানি না বা বিশ্বাস করতে চাই না যে, শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগ হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্য এই যে, শিশু জন্মের তিন বছর পর থেকে তারা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছে বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ, স্কুল পালানো, খাদ্যগত সমস্যা, ওটিসম (এটি ৩ বছরের পূর্বে দেখা দেয়) আচরণগত সমস্যা, চঞ্চলতা রোগ। অন্যান্য মানসিক রোগের মধ্যে আছে মাদকাশক্তি, মৃগীরোগ জনিত মানসিক রোগ, মানসিক প্রতিবন্ধী প্রভৃতি। মানসিক রোগ এক নীরব ঘাতক ব্যাধি তাই এই রোগ সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত এবং সচেতন হওয়া উচিত।
———————-
ডাঃ গৌতম কুমার দাস
কানাইপুর, ফরিদপুর
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ এপ্রিল ২০০৮
Leave a Reply