৩০ বছরের গড় আবহাওয়ার পরিমাপকে বলে জলবায়ু বা ক্লাইমেট। জলবায়ু প্রতিনিয়তই একটু একটু করে পরিবর্তিত হচ্ছে। গত শতাব্দীতে এই পরিবর্তন খুব দ্রুত হয়েছে এবং ক্রমেই মানবসভ্যতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ববাসী এখন সোচ্চার। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নপ্রসূত গ্রিন হাউস গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে বাড়ছে উষ্ণতা, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, বাড়ছে দুর্যোগ। মানবসৃষ্ট এই ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ মোকাবিলার জন্যই ‘জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশন’-এর (ইউএনএফসিসিসি) সৃষ্টি। বিশ্বের ১৯৫টি দেশ এর সদস্য। প্রতিবছর এই কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত সদস্য দেশগুলোর বার্ষিক সম্মেলন হয়, যা ‘কনফারেন্স অব পার্টিস’ নামে পরিচিত। গত ২৬ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাতারের দোহায় এর ১৮তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ১৯৫টি সদস্যদেশের প্রায় ১৭ হাজার সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য
অনেকেই ভাবতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাস্থ্যের আবার সম্পর্ক কী? সম্পর্ক আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী আরও বেশি উষ্ণ ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠবে। মানুষের শারীরবৃত্ত ও রোগবালাই চারপাশের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। তাই ধারণা করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের ওপর যে যৌগিক চাপ ফেলবে, তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাবে অনেক গুণ। স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে, আর আছে কিছু পরোক্ষ প্রভাব।
হিট স্ট্রোক
উষ্ণতা বাড়ার কারণে, বিশেষ করে শহর এলাকায় মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
শ্বাসপ্রশ্বাস-সংক্রান্ত রোগ
২০২০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য অবনতির প্রধান ১০টি রোগের মধ্যে একটি হবে শ্বাসজনিত রোগ। মানুষের জীবনধারা ও পরিবেশ শ্বাসজনিত রোগকে প্রভাবিত করে। ঘরে ও বাইরে বহুক্ষণ ধরে বায়ুদূষণের মধ্যে কাটানোর পর শিশুদের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত অসুস্থতা বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোনো কোনো গাছপালার রেণু উৎপাদন বেড়ে যাবে। সে জন্য কিছু লোকের হাঁপানি ও অ্যালার্জি বেড়ে যাবে।
পানিবাহিত রোগ
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনের বিদ্যমান সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং তুলবে জলবায়ু পরিবর্তন। ২০২০ সালের মধ্যে উদরাময়জনিত রোগবালাই শতকরা ২ থেকে ৫ ভাগ বেড়ে যাবে বলে জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ ছাড়া তাপমাত্রা উষ্ণ থাকলে সমুদ্রে ঘন ঘন শৈবাল জন্মায়, বিশেষ করে যেখানে দূষিত পানি রয়েছে, আর শৈবালের সঙ্গে কলেরা-জীবাণুর সংশ্লিষ্টতা থাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
কীটপতঙ্গবাহিত রোগ
সংক্রামক রোগ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ঘাতক। যেসব অঞ্চলে মশা, মাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেসব অঞ্চলে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনে ‘ভেক্টর’ অণুজীব যেমন: মশা, মাছি, ইঁদুর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বেশি বংশ বৃদ্ধি করবে। ফলে বাড়বে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, কালাজ্বর ইত্যাদি। রোগমুক্ত অঞ্চলগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কতগুলো বিশেষ ভেক্টরবাহিত রোগের উদ্ভব ঘটতে পারে—বান্দরবান থেকে ম্যালেরিয়া হয়তো সাতক্ষীরায় চলে যাবে—একটা বড় ধরনের রোগতাত্ত্বিক পরিবর্তনও ঘটবে।
পুষ্টির সমস্যা
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে, ফসলহানি ঘটবে। মাছ ও জলীয় উদ্ভিদের ক্ষতি হবে। প্রোটিনের প্রধান উৎস মাছ, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে। পর্যাপ্ত ও সুষম খাবারের অভাবে পুষ্টির সমস্যা বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বাড়ার কারণে অপুষ্টিজনিত রোগে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে অনেক। পৃথিবীতে ১৭০ কোটি লোক এমন জায়গায় বাস করে, যেখানে মাঝেমধ্যেই পানির অভাব হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ পানির অভাবে ভুগবে ৫০০ কোটি লোক। পানি ও খাবারের অভাবে কৃষক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির সমস্যা প্রকট হবে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দলে দলে জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে শহরমুখী হবে।
মনঃসামাজিক চাপ
উষ্ণপ্রবাহ, শৈতপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা। দুর্যোগে বিপর্যস্ত পরিবারের জীবন-জীবিকা হারানোর মানসিক যন্ত্রণা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। বিপর্যয়-পরবর্তী সময়ে অনেকেই মানসিক অসুস্থতার (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেম ডিসঅর্ডার—পিটিএসডি) শিকার হয়ে থাকেন। এই চাপ বা পীড়াদায়ক পরিস্থিতি মানুষের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতাও কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার জন্য অ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন—দুই ক্ষেত্রেই আমাদের জোর দিতে হবে। বিশেষ করে স্থানীয় অভিজ্ঞতা থেকে অভিযোজনের মাধ্যমে কার্যকরভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করার উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিট সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছে।
কপ ১৮ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা
স্বাস্থ্যকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার জোর দাবি উঠেছে বিশ্বব্যাপী। দোহা সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে স্বাস্থ্যকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মূল আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবি জানিয়েছেন স্বল্পোন্নত দেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধিরা। মাটি, পানি, বায়ু—এ তিনটির সঙ্গেই স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রীয় আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশক।
ডা. ইকবাল কবীর, দোহা (কাতার) থেকে ফিরে
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৯, ২০১২
Leave a Reply