বোস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসের ইনস্ট্রাক্টর এমিলি মানসন সাহায্য করছিলেন হাসপাতালের শিশুরোগী চার বছরের লরেন মানজকে কাগজের লণ্ঠন তৈরিতে। বোস্টনের শিশু হাসপাতাল শ্রেষ্ঠ শিশু হাসপাতাল আমেরিকাতেও। স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য। উদ্ভাবনী নানা কৌশল স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। বাচ্চাদের চিত্রশিল্প বা হস্তশিল্প শেখানোর ব্যাপারটি বেমানান মনে হলেও নিরাময়ের জন্য বেশ ফলপ্রসূ মনে হয়েছে।
সেদিন বিকেলে বোস্টনের ফাইন আর্টস মিউজিয়াম থেকে এসেছিলেন প্রশিক্ষক জেসন স্প্রিংগার। রোগী ও তাদের অভিভাবকদের চীনা লণ্ঠন নির্মাণ করা শেখাচ্ছিলেন।
হাসপাতালের রোগীদের বিনোদনকেন্দ্রে শেখাচ্ছিলেন। জেসন স্প্রিংগার বলছিলেন, ‘এই হচ্ছে তোমাদের তুলি, রঙের পাত্র, ব্রাশ। যত বেশি ঘষবে তত বেশি গাঢ় হবে রং।’ স্প্রিংগারের পেছনে একটি প্রজেক্টর থেকে মিউজিয়ামের এশিয়ান আর্টের বিশাল সংগ্রহ থেকে নেওয়া চীনা ও জাপানি ব্রাশ পেইটিংয়ের প্রতিচ্ছবি দেখানো হচ্ছিল।
এই পাহাড় ও গাছের প্রতিচ্ছবি থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার কথা বললেন তিনি। ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত পরিদর্শন করেন তিনি বোস্টন হাসপাতাল। আগে মাসে এক দিন আসতেন, এখন আসেন মাসে দুই দিন। সঙ্গে আসে মিউজিয়ামের আর্টফুল হিলিং প্রোগ্রাম। শিশুদের জন্য অনুষ্ঠিত হয় চিত্রশিল্প কর্মশালা, সে সঙ্গে জাদুঘরের সংগ্রহ থেকে নানা উপকরণ। কর্মসূচি বিস্তৃত হলো ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত। এমনকি ডানাফার্বার ক্যানসার ইনস্টিটিউটেও গেল সেই কর্মসূচি।
ল্যান্টার্ন কর্মশালায় আট বছরের রিলে রোমান বসেছিল আর দুটো কম বয়সী আগন্তুকের সঙ্গে: হাসপাতালে আসা এখন খেলার ও মজা করার ব্যাপার হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। রিলে বলল, ‘আর্ট আমার সবচেয়ে প্রিয়। এরপর ভিডিও গেমস।’
রিলের মগজে টিউমার হয়েছে। হাসপাতালের চিত্রশিল্প ও কারুশিল্পের প্রদর্শনীতে তার বড় আগ্রহ। তার মা এন্ড্রিয়াও খুশি, ‘রিলের জন্য বড় আমোদের ব্যাপার এটি।’ তাঁর ছেলে তার নাম অঙ্কন করছিল শিল্পকর্মে। মিসেস রোমান বলছিলেন কী করে তাঁর ছেলের শরীরের ডান দিক গত শীতে কেমন অবশ হলো সে অনুভব করল। এখন তার হাতের শক্তি বেশ ফিরে এসেছে; বেশ নিরাময় হলো তার অসুখ।
কাছেই লরেন মানজ একটি রঙের ব্রাশ দিয়ে রং করছিল হাসিমুখে। ওষুধের পাহাড় তার পেছনে, ভ্রুক্ষেপই করল না।
লরেন ওখানে তিন মাস। দুরারোগ্য একটি অটোইম্যুন রোগ হয়েছে তার, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Opsoclonus-myoclonus Syndৎome, টিউমার অপসারণের পর তার প্যানক্রিয়াসেও প্রদাহ হয়েছে।
কিন্তু সে মুহূর্তে লরেন তার ল্যান্টার্নটি তৈরি করতে ব্যস্ত: চার বছরের বাচ্চার মুখে-চোখে রাজ্যের মনোযোগ।
লরেনের মা বলছিলেন, ‘এই শিল্প শিল্প খেলা তার মনকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে নেয়, কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলে যায় তার অসুখের কথা, তীব্র ব্যথার কথা। এলিসিয়া মানজ, লরেনের মা বসেছিলেন তার কাছেই।
অনেক বাচ্চার জন্য, এই অন্যমনস্ক করার ব্যাপারটি, মনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া এ যেন অন্যতর এক সুযোগ—শিশুর উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও কৌশলের দ্বার উন্মোচন করা—একসঙ্গে নিরাময়ী ও নবচেতনাবোধ, দুঃখ ভোলা—কর্মশালার উদ্দেশ্য ছিল এটাই। চিত্রশিল্প নিরাময়ের একটি বড় মাধ্যমও হতে পারে।
দি সোসাইটি ফর দি আর্টস ইনহেলথকেয়ার তাদের ২০০৯ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, উপাত্তগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের হেলথ কেয়ার কর্মসূচির ৪৫ শতাংশ কর্মসূচিতে চিত্রশিল্পকে ব্যবহার করে। এর মধ্যে চিত্রশিল্প প্রদর্শনী, বেড সাইড কর্মশালা ও পারফরম্যান্স। গবেষকেরা দেখেছেন এসব কর্মসূচিতে রোগীর চাপ লঘু হয় এবং বাড়ে জীবনের গুণগত মান। এমনও দেখা যাচ্ছে যে এ রকম উন্নতির জন্য চিত্রশিল্প কর্মসূচি হয়তো স্বাস্থ্য খাতে খরচও কমাবে এভাবে।
এসব কর্মসূচির একটি লক্ষ্য: ইতিবাচক দিকটি, মনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া ইতিবাচক দিকে। শিশু হাসপাতালের শিল্প কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার জেসিকা কিন্চ বলেন, এ কথা এই কর্মসূচির সংযোগ মিউজিয়ামের সঙ্গে হওয়ায় এই কর্মসূচি অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছে, চিত্রশিল্প, কারুশিল্পের সীমানা পেরিয়ে আরও গভীরে। এটি হয়েছে সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতারও অংশ, বেশ উদ্দীপক ব্যাপার এটি। আর্টফুল হিলিং প্রোগ্রামের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় রয়েছেন হাসপাতাল, চিত্রশিল্পী ও জাদুঘরের কর্মকর্তারা।
এ দিকটি একটি নতুন ভাবনার দিক হবে রোগ নিরাময়ে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
ছবিঃ আর্টফুল হিলিং: চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর মাধ্যমে ইতিবাচক চিকিত্সার নতুন দিক শিশু হাসপাতাল, বোস্টন, যুক্তরাষ্ট্র।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১২, ২০১২
Leave a Reply