নিঃসঙ্গতা হতে পারে যেকোনো বয়সে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতা নিয়ে আসতে পারে গুরুতর স্বাস্থ্য-পরিণতি। আগাম মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন তেমনি রুগ্ণ স্বাস্থ্যও হতে পারে; সম্প্রতি এক গবেষণায় তা দেখা গেছে।
রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা মেডিকেল জার্নাল আর্কাইডস অব ইন্টারন্যাশনাল মেডিসিন-এ। জীবন গোধূলির বছরগুলোতে নিঃসঙ্গতা-উত্তর-যৌবনের কিছু মানুষের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা।
সানফ্রান্সিসকোতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জরাবিজ্ঞানীরা ষাটোর্ধ্ব এক হাজার ৬০৪ জন লোকের ওপর গবেষণা করলেন, লক্ষ করলেন কতবার তারা নিঃসঙ্গ বা প্রত্যাখ্যাত বোধ করেন, সঙ্গীহীন থাকেন। গবেষকেরা নিঃসঙ্গতার পরিমাণগত দিকটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন—অন্যদের সঙ্গে অর্থবহ সংস্পর্শ বা সংযোগ নেই; সে সঙ্গে বেদনাময় অস্বস্তির দিকও।
এ ব্যাপারে প্রশ্নোত্তরমালা পূরণ করা হলো ২০০২ সালে প্রতি দুই বছর পর পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত; বয়স্ক যেসব লোক নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন—৪৩ শতাংশের একটু বেশি; সেই বছরগুলোতে তাদের বোধের তেমন পরিবর্তন হলো না—রিপোর্টটি করলেন মুখ্য গবেষক ক্লিনিক্যাল সহকারী অধ্যাপক কার্লা পেরিসিনোটো। ১৩ শতাংশ বয়স্ক লোক বললেন প্রায়ই তাদের নিঃসঙ্গ লাগে; ৩০ শতাংশ বললেন মাঝেমধ্যে একাকী বোধ হয় তাঁদের।
এই ছয় বছরে বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের স্বাস্থ্য কেমন ছিল? যাঁরা নিঃসঙ্গ ও অসুখী বোধ করছিলেন, কেমন ছিল তাঁদের স্বাস্থ্য? ২০০৮ সালের মধ্যে সেই গ্রুপের সিনিয়রদের ২৪.৮ শতাংশ, যাদের পারফরমেন্স-ক্ষমতা বেশ খর্ব হলো; দৈনন্দিন জীবনযাপনের সেই শক্তি কমে গেল; স্নান করা-পোশাক পরা-আহার-বাথরুম করা চেয়ার বা শয্যা থেকে উঠে দাঁড়ানো, নিজে নিজে এসব কাজ করার ক্ষমতা বেশ কমে গেল। যাঁরা নিঃসঙ্গ নন, এঁদের মধ্যে মাত্র ১২.৫ শতাংশের তেমন জীবনের শক্তি কিছুটা খর্ব হওয়ার অনুভূতি হলো মাত্র।
নিঃসঙ্গ বুড়ো মানুষদের প্রায় ৪৫ শতাংশের আগাম মৃত্যুর শঙ্কা বেশি, অন্তত যাঁরা সঙ্গী-সাথি নিয়ে আমোদে দিন কাটান তাঁদের তুলনায়।
অর্থবহ সম্পর্কের গুরুত্ব বেশি—নিঃসঙ্গতা বিচার করতে গেলে এর তাৎপর্য বেশি। একাকী থাকাটা বড় কথা নয়, মূল কথা হলো ‘অর্থবহ সম্পর্ক’। ৬৫ শতাংশ বয়স্ক লোকই ছিলেন বিবাহিত। সামাজিক সম্পর্কই কেবল এ নিঃসঙ্গতার কারণ তাও নয়। চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়েও মানুষ একাকী বোধ করতে পারেন, যদি পরস্পর অর্থবহ সম্পর্ক না থাকে। ভাবের আদান-প্রদানে যদি আবেগ ও অনুভূতির দেওয়া-নেওয়া সমান তালে না হয়; তাহলে নিঃসঙ্গ বোধ হয় মানুষের ভিড়েও।
সম্পর্ককে মানুষ কীভাবে বিষয়গতভাবে বোধ করে, মূল্যায়ন করে; কত বেশি মানুষের সঙ্গে জানাশোনা, মেলামেশা তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্পর্কের মধ্যে গভীরতা কী আছে, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক কী, সেগুলো বিবেচ্য বিষয়।
বয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকার জন্য সামাজিক অবলম্বন সোশ্যাল সাপোর্ট খুব প্রয়োজন, বলেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি দীর্ঘায়ুর জন্যও প্রয়োজন। সামাজিক অবলম্বন ও নিঃসঙ্গতা দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে প্রবীণদের জীবনের ওপর। প্রতিটি নিজস্ব উপায়ে প্রভাব ফেলে জীবনে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে বাস করেন ৮৫ বছর বয়সী জ্যাজ অ্যান্ড ব্লুজ গায়ক বারবারা ডেন, বলছিলেন, যত বুড়ো হওয়া যাবে মনে হবে পৃথিবী ছাড়া, তাই নিজে যেন নিষ্ক্রিয় হতে থাকি, ভাবি অন্যকে আর বিরক্ত করা নয়, তাই নিজের লোকদের সঙ্গ যেন চ্যুত হতে হয় আর তা বোঝার আগেই মন বেজায় খারাপ হয়ে যায়।
এ যেন নিজেকে পূর্ণ করা, ভরে দেওয়ার খেলা; সূর্যাস্তের দিকে নির্নিমেষ চোখ; আর সেই লক্ষ্যে পথচলা যেন শুরু।
বয়স্কদের ওপর নিঃসঙ্গতার প্রভাব—এর ব্যাখ্যা অনেকে করেছেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজিও হেলথ কেয়ারের পরিচালক এন্ড্রু স্টেপটো এই বিষয় বেশ অধ্যয়ন করেছেন। একাকিত্ব এবং সামাজিক অন্তরণ—দুটোই এমন সব জৈবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত যা বাড়িয়ে দেয় স্বাস্থ্যঝুঁকি; এমনকি দেহ প্রতিরোধব্যবস্থাও প্রদাহ-প্রক্রিয়ায় আনে পরিবর্তন এবং চাপসম্পর্কিত হরমোন মানেও আনে বিশৃঙ্খলা। বলেন এন্ড্রু স্টেপটো।
২০১১ সালে সাইকোলজিও এজিং নামে একটি চিকিৎসা জার্নালে আরও একটি ক্লুর সন্ধান দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেই রিপোর্টে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এনথনি ওএনজি বলেন, ‘বয়স্ক লোকদের রক্তচাপ বাড়ে কয়েক ধরনের চাপের অধীন হলে এবং নিঃসঙ্গতা এই প্রতিক্রিয়াকে অনেক বাড়িয়ে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, নিঃসঙ্গতা এমনই যে জীবনের শেষ বছরগুলোতে থাকে নীরবে; আর তাই একে স্ক্রিন করে দেখা উচিত এবং একে উদ্ধার করার পদ্ধতি বের করা দরকার।
বয়স্ক ও বুড়ো বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের কাছে যাওয়া, পাশে থাকা, বাক্যালাপ করা যদি যায় সব সময়, তাহলে বেশ লাভ হয়।
পেরিসিনেটো বলেন, কখনো কখনো এমন হয় যে বয়স্ক লোক যদি বোঝেন যে কেউ তাঁদের কথা শুনছে, তাঁদের অবহেলা করছে না, এমন অনুভূতিও বেশ উপকারী হতে পারে তাদের শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের জন্য।
আমাদের দেশেও প্রবীণ লোকদের সংখ্যা বাড়ছে, তাই তাদের জীবনের এ দিকটি, নিঃসঙ্গ জীবন থেকে তাঁদের সরিয়ে এনে সামাজিক সম্পর্ক ও আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সংস্পর্শ এবং তা যদি অর্থবহ হয়, এতে যদি গভীরতা থাকে তাহলে প্রবীণদের জীবনও হবে আনন্দময়।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৫, ২০১২
Leave a Reply