‘ব্রংকিওলাইটিস’ ছোট্ট সোনামণিদের ফুসফুসের একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যাতে আক্রান্ত শিশুরা ভয়ানক কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগে। সাম্প্রতিক সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে এ রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। অসংখ্য আক্রান্ত শিশু চিকিৎসক, শিশুরোগবিশেষজ্ঞ, এমনকি বিভিন্ন হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসছে। অসুখের তীব্রতার জন্য এদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও খবরে রোগের তীব্রতা ও জটিলতার কারণে মৃত্যুর সংবাদও আসছে। তা-ই প্রত্যেক মা-বাবাকেই এই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
আগেই বলেছি, ‘ব্রংকিওলাইটিস’ শিশুদের ফুসফুসের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আরএসভি ভাইরাস দিয়ে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা, প্রধানত যাদের বয়স ছয় মাসের কম তারাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। যেসব শিশুর মায়ের বুকের দুধ পান করানো হয়নি, যারা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকে, যাদের জন্মের সময় ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম ছিল—তাদের এ রোগে ভুগতে বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া, আর্থিক অসচ্ছলতা, দূষিত অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, এমনকি বাবা বা মায়ের ধূমপানের জন্যও ছোট্ট শিশু ‘ব্রংকিওলাইটিস’-এ আক্রান্ত হতে পারে। বছরের যেকোনো সময়েই এ রোগ হতে পারে। তবে শীত, বর্ষা ও বসন্তকালের শুরুতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
এ রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর নাক দিয়ে পানি ঝরে, হাঁচি থাকে, সঙ্গে হালকা জ্বরও থাকতে পারে। পরবর্তী সময়ে কাশি, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া (যা মিনিটে ৫০-৬০ বারের বেশিও হতে পারে), শ্বাসকষ্ট, বুকের খাঁচা দেবে যাওয়া, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাঁশির আওয়াজের মতো একধরনের শব্দও হতে পারে। আক্রান্ত শিশুরা অতিরিক্ত কান্নাকাটি করে, অস্থির থাকে। শ্বাসকষ্টের জন্য তাদের খেতে ও ঘুমাতে সমস্যা হতে পারে। কারও কারও দ্রুত শ্বাসের সঙ্গে হূৎস্পন্দনও বেড়ে যায়। উপসর্গ দেখেই এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। রক্ত পরীক্ষা এবং বুকের এক্স-রে রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। কিন্তু শুধু রোগের ইতিহাস, উপসর্গের সঙ্গে শারীরিক লক্ষণ দেখে যদি দ্রুত রোগ নির্ণয় করা যায় এবং সে অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসা করা যায়; তবে শিশুকে অহেতুক সুইয়ের খোঁচা এবং এক্স-রের তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা যায়।
তীব্র ‘ব্রংকিওলাইটিস’-এ আক্রান্ত শিশুর কোনো মারাত্মক জটিলতা না থাকলেও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রয়োজনে অক্সিজেন, নেবুলাইজেশন, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল সিরাপ দিতে হবে। যেহেতু রোগাক্রান্ত অনেক শিশুই ঠিকমতো খেতে পারে না, তাই যাতে খাদ্যাভাব ও পুষ্টিহীনতায় না ভোগে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে নাকে নল দিয়ে খাবার দিতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিরায় স্যালাইনও দিতে হয়। বেশির ভাগ শিশুই মায়ের বুকের দুধ পান করতে পারে এবং তাদের অবশ্যই ঘন ঘন বুকের দুধ পান করাতে হবে। শোয়ানোর সময় মাথার নিচে বালিশ দিয়ে মাথা কিছুটা উঁচু রাখতে হবে। দুই নাক সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। নাক বন্ধ থাকলে, সাধারণ স্যালাইন ড্রপ দিয়ে খোলা রাখতে হবে। সাধারণত এ রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনের প্রয়োজন নেই। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে মুখে ইরাইথ্রোমাইসিন দিতে পারেন, যদি না কোনো জটিলতা থাকে। হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মনিটর করতে হবে, এ জন্য পালস অক্সিমেট্রি ব্যবহার করা যায়।
ছোট্ট শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম থাকে। তাই যেকোনো সময়ই তারা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ‘ব্রংকিওলাইটিস’-এর প্রতিষেধক কোনো টিকা নেই। তাই এ রোগ প্রতিরোধের জন্য মা-বাবার সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন—
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খেতে দিন। ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি অন্যান্য পারিবারিক খাবার দিন।
শিশুকে পরিষ্কার রাখুন। প্রতিদিন গোসল করান। যদি সম্ভব না হয় তবে শরীর ভালো করে মুছিয়ে দিন।
শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও খোলামেলা পরিবেশে রাখুন।
প্রতিবার শিশুকে ধরার আগে বিশেষ করে খাওয়ানোর আগে এবং বাচ্চার প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কারের পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন।
শিশুর সামনে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকুন।
শিশুর ঠান্ডা লাগলে নাক পরিষ্কার রাখুন, প্রয়োজনে সাধারণ স্যালাইন ড্রপ নাকে দিতে পারেন, দিনে তিন-চারবার।
জ্বর থাকলে সারা শরীর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুছিয়ে দিন, প্রয়োজনে প্যারাসিটামল সিরাপ দিতে পারেন।
ঠান্ডা, কাশি, জ্বর থাকলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিন।
বাসায় শিশুর শ্বাসের গতি পর্যবেক্ষণ করুন।
শিশু ঘন ঘন শ্বাস নিলে, শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে, বুকের খাঁচা দেবে গেলে, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করতে পারলে, জ্বর অতিরিক্ত বেড়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে নিকটস্থ হাসপাতালে অবশ্যই নিয়ে যাবেন।
‘ব্রংকিওলাইটিস’ সাধারণত পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে আপনা-আপনিই ভালো হয়ে যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। একবার ‘ব্রংকিওলাইটিস’-এ আক্রান্ত শিশুর পরবর্তী সময়ে ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট হতে পারে, কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে অ্যাজমাতে ভোগে, বিশেষ করে যেসব পরিবারে এলার্জি ও অ্যাজমার ইতিহাস আছে। তাই এ বিষয়ে মা-বাবাকে অবশ্যই অবহিত হতে হবে।
অধ্যাপক এ আর এম লুৎফুল কবির, অধ্যাপক মো. আবিদ হোসেন মোল্লা, অনিমা ফেরদৌস
শিশু বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৮, ২০১২
Leave a Reply