সুস্থ-সবল নবজাতক হোক সবারই কাম্য। ১৭ নভেম্বর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হলো বিশ্ব প্রিম্যাচিউরিটি দিবস। ৩৭ সপ্তাহ বা ২৫৯ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্ম নেওয়া শিশুকে বলা হয় অপরিপক্ব (প্রিম্যাচিউর) নবজাতক
একজন নবজাতক সাধারণত ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিন মায়ের গর্ভে থাকার পর জন্মগ্রহণ করে। এ সময় শিশু পৃথিবীতে এসে বেঁচে থাকার মতো পরিপক্বতা ও শক্তি অর্জন করে। কখনো কখনো সময়ের আগেই শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়। ৩৭ সপ্তাহ বা ২৫৯ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্ম নেওয়া শিশুকে বলা হয় প্রিম্যাচিউর নবজাতক।
সারা বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ৫০ লাখ নবজাতক ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম লাভ করে। অর্থাৎ প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে একটি প্রিম্যাচিউর। তাদের মধ্যে অনেকেই থাকে স্বল্প ওজনের বা দুই হাজার ৫০০ গ্রামের কম।
দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার, বিশেষ করে নবজাতকের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। আমাদের দেশে নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রিম্যাচিউরিটি বা সময়ের আগে জন্ম নেওয়া। পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া এবং দ্বিতীয় কারণ প্রিম্যাচিউরিটি। যেসব শিশু বেঁচে থাকে, তারাও সারা জীবন শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে থাকে।
এসব নবজাতকের ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন ও আমাদের সচেতন হওয়ার এখনই সময়। সবার সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ১৭ নভেম্বর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হলো বিশ্ব প্রিম্যাচিউরিটি দিবস।
সময়ের আগে জন্ম নেওয়া বা প্রিম্যাচিউরিটির বিভিন্ন কারণ রয়েছে, এর মধ্যে গর্ভকালীন শিশু ও মায়ের কিছু সমস্যা অন্যতম। যেমন—
যমজ শিশু
গর্ভফুল নিচে থাকা
জরায়ুর ত্রুটি
গর্ভবতী মায়ের অতিরিক্ত রক্তচাপ
মায়ের কিডনি বা হূৎপিণ্ডের সমস্যা
মূত্রনালির সংক্রমণ বা অন্যান্য সংক্রমণ
জরায়ুতে পানি বেশি থাকা
সময়ের আগেই পানি ভেঙে যাওয়া
জরায়ুতে আঘাত পাওয়া
মায়ের ধূমপান বা তামাক খাওয়া
মায়ের অপুষ্টি
অল্প বয়সে গর্ভধারণ করা
ঘন ঘন সন্তানের জন্ম দেওয়া
সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এসব নবজাতকের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপরিপক্ব থাকে বলে জন্মের পর পরই তারা মৃত্যুবরণ করে অথবা বিভিন্ন সমস্যা বা রোগে দ্রুত আক্রান্ত হয়।
করণীয়
আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে কোনো নবজাতকের সময়ের আগে জন্ম না হয়, এর প্রতিরোধ করা এবং জন্ম নেওয়ার পর তার যথাযথ পরিচর্যা করা।
প্রতিরোধের উপায়
পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। কারণ, ঘন ঘন সন্তান হলে মায়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এ কারণে গর্ভের শিশু বাড়তে পারে না, স্বল্প ওজনের হয় এবং সময়ের আগেই জন্ম নেয়।
গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। গর্ভের শিশু ও মায়ের ওপর উল্লিখিত কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করা।
পরিবারের সদস্যদের সচেতন করা।
পরিচর্যা
প্রিম্যাচিউর শিশু, বিশেষ করে যদি স্বল্প ওজনের হয়, তাহলে তাদের জন্য বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। মনে রাখতে হবে, উচ্চপ্রযুক্তির স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াই এই শিশুদের শতকরা ৭৫ ভাগকে বাঁচানো সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। অতি প্রয়োজনীয় নবজাতকের যত্ন তার মধ্যে একটি। যেমন: শিশুকে পরিষ্কার ও গরম রাখা, বুকের দুধ খাওয়ানো, শ্বাসকষ্ট থাকলে জরুরিভাবে শ্বাস নিতে সাহায্য করা, প্রয়োজনে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠানো, জরুরিভাবে জীবাণু সংক্রমণ শনাক্ত করা এবং যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রদান করা উল্লেখযোগ্য।
দুটি সহজলভ্য ও কম খরচের পদ্ধতিও অনেক শিশুর জীবন বাঁচাতে পারে। যেমন, গর্ভকালীন মাকে স্টেরয়েড-জাতীয় ইনজেকশন দেওয়া, যা জন্মের পর প্রিম্যাচিউর শিশুর শ্বাসকষ্ট কমাতে সাহায্য করে। আরেকটি হলো, ক্যাঙারু মাদার কেয়ার, অর্থাৎ শিশুকে মায়ের বুকের উষ্ণতায় রেখে একই কাপড় দিয়ে মা ও শিশুকে ঢেকে রাখা। এতে শিশুর শরীর উষ্ণ থাকে এবং প্রয়োজনে শিশু মায়ের দুধ খেতে পারে। এই দুটি পদ্ধতি প্রায় চার লাখ শিশুর জীবন বাঁচাতে পারে, যদি তা আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করতে পারি।
সবশেষে বলা যায়, পরিবার পরিকল্পনা, নারীর ক্ষমতায়ন, গর্ভকালীন পরিচর্যা ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এবং আমাদের সবার সার্বিক প্রচেষ্টায় সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারি, বাঁচাতে পারি লাখো নবজাতকের প্রাণ।
অধ্যাপক তাহমীনা বেগম
শিশু বিভাগ, বারডেম ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২১, ২০১২
Leave a Reply