এক.
২৪ বছরের তরতাজা তরুণ মারুফ একরাশ বিষণ্নতা আর আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন চিকিৎসকের দিকে। মাত্র বিবিএ শেষ করে একটা বেসরকারি অফিসে ঢোকা, এখনো বিয়ে করা হয়নি। সামনে পড়ে আছে গোটা জীবন। বলতে গেলে জীবনের কেবল শুরু। আর এ সময় শরীরের অলিগলিতে ডায়াবেটিস নামের রোগটির অস্তিত্ব কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মারুফ।
ডায়াবেটিস? এই এত অল্প বয়সে? এখনই? নাহ্, কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এই যে এত এটা-ওটা ভালো-মন্দ খাওয়া পছন্দ তাঁর, এক বেলা বার্গার তো পরের বেলা চিকেন ফ্রাই। বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই ফাস্টফুড বা তেহারির দোকানে আড্ডাটা দেওয়া তাঁর প্রিয়। মায়ের হাতের গরুর মাংস ভুনা কি দাদির তৈরি ঘন দুধের পায়েস, রোজ বিকেলে তাঁদের বাড়িতে পাড়ার দোকানের শিঙাড়া, সমুচা বা ডালপুরি ছাড়া তো চলেই না। রাত জেগে ইন্টারনেটে গুগল সার্চ আর ফেসবুকে ঘোরাঘুরির সময় ফ্রিজ খুলে কেক-পেস্ট্রি-কোক খাওয়া নিত্যদিনের অভ্যাস। এসব প্রিয় জিনিস সব বন্ধ করতে হবে? এখন সবকিছুতে নিষেধ আর মানা? অসম্ভব, অসম্ভব!
দুই.
প্রায় একই বয়সের আরেক তরুণ জয়নাল এক ভিন্ন পরিস্থিতির শিকার। মুন্সিগঞ্জের একটি গ্রামের এইচএসসি পাস করা বেকার তরুণ জয়নাল বাবার কৃষিজমি বিক্রির টাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে। ওমানে এক বৈদ্যুতিক পণ্যের দোকানে কাজ করা জয়নাল যেমন রোজগার করতেন, তেমনই দেদার খরচ করতেন। বন্ধু ও সতীর্থ মহলে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন উদারতার জন্য। কাবাব, বিরিয়ানি, ম্যাগডোনাল্ডস, চকলেট, জুস, কোমল পানীয়—এসব যেমন খেতেন, তেমনি খাওয়াতেন। মাকে ফোন করে শোনাতেন কত রকমের মজাদার আর লোভনীয় সব খাবার-দাবার এসব দেশে সহজেই পাওয়া যায়, যা দেশে থাকতে কখনো চোখেই দেখেননি। দুই বছরে ওজন বেড়ে গেছে আট কেজি। তার পরই একদিন বিপত্তি। কারখানায় কাজ করতে গিয়ে সামান্য এক আঘাত থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ। ইনফেকশন সারে না দেখে স্থানীয় চিকিৎসক ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে দেখেন ২৫ মিলিমোল সুগার, অতঃপর পত্রপাঠ বিদায়। সোজা দেশের বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হলো জয়নালকে। হতাশ, অসুস্থ, কাহিল আর ভেঙে পড়া যুবক ছেলেকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর দরিদ্র বাবা।
ওপরের ঘটনা দুটি প্রায় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। এ রকম মারুফ আর জয়নালের সঙ্গে প্রায় হররোজই দেখা হয় আমাদের। সম্ভাবনাময়, প্রাণশক্তিতে টগবগ তারুণ্যের গায়ে ডায়াবেটিসের চপেটাঘাতের এই কাহিনি আজ ঘরে ঘরেই মেলে। কত দ্রুত আর ভয়ানকভাবে এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে। থামিয়ে দিচ্ছে তাদের প্রাণশক্তি আর সম্ভাবনা, দমিয়ে দিচ্ছে তাদের কর্মস্পৃহা, ধ্বংস করে ফেলছে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তারুণ্যকে, তা কিছুদিন আগেও কল্পনার বাইরে ছিল। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় যে-সংখ্যক ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশেরই বাস আমাদের বাংলাদেশে। বাংলাদেশের গোটা জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
অন্য সময়ের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম বয়সে ও তরুণ বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়েছে আমাদের দেশে। যে হারে বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্জন করবে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অষ্টম স্থান। কিন্তু আমরা কি এটা চাই?
কেন এই মহামারি?
ত্রিশ বা চল্লিশের দশকে কলেরা বা বসন্তের মতো মহামারিতে উজাড় হতো গাঁয়ের পর গাঁ। ডায়াবেটিসের ব্যাপকতা ও বৃদ্ধির হার আজ সেসব মহামারির কথাই মনে করিয়ে দেয়। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে হেন কোনো পরিবার থাকবে না, যেখানে ডায়াবেটিক রোগী নেই। কিন্তু কেন এই মহামারি? চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যে কয়েকটি জিনিসকে ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষ ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মন্দ খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক শ্রমে অনীহা। বয়স, বংশযোগ, স্থূলতা ও ওজনাধিক্য, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ইতিহাস, মানসিক চাপ ইত্যাদি এই ঝুঁকিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। বিগত দুই বা তিন দশকে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শহরাঞ্চলে শিশু-কিশোরেরা ব্যাপকভাবে ফাস্টফুড, জাংকফুড, কোমল পানীয় ও ভাজা-পোড়া খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। স্কুলের টিফিন থেকে বাড়ির নৈশভোজ—সর্বত্রই বাড়িতে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবারের বদলে স্থান করে নিয়েছে চিকেন ফ্রাই, বার্গার, পিৎজা, পেস্ট্রি বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। রেস্তোরাঁয় ও বাইরে খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংলগ্ন ফাস্টফুড দোকানগুলো রমরমা। সন্ধ্যা বা বিকেলে চেইন রেস্তোরাঁগুলোয় রীতিমতো লাইন ধরে জায়গা নিতে হয়। জন্মদিন, বন্ধুদের আড্ডা বা যেকোনো উৎসব উদ্যাপনের জায়গা হচ্ছে রেস্তোরাঁ। বাড়ির হেঁশেল আর মায়ের রান্না বিদায় নিয়েছে এসব থেকে। আজকের ব্যস্ত মা-বাবাও ব্যস্ততার অজুহাতে শিশুর ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন দোকান থেকে কেনা বার্গার বা ফ্রোজেন ফুড বা ভেজে নেওয়া টিফিন। হাসিমুখে উপদেশ দেন বাইরের পানি খেয়ো না, বরং একটা কোমলপানীয় কিনে খেয়ো।
ছুটির দিনে সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার অর্থ হলো শপিং কমপ্লেক্সে খানিক ঘোরাঘুরির পর ফুড কোর্টে খাওয়া-দাওয়া করা, আত্মীয়স্বজনকে দেখতে আজকাল কে-ই বা যায়? এই মন্দ খাদ্যাভ্যাসের কারণে আজকের শিশু-কিশোরদের মধ্যে একটা বিশাল অংশ ইতিমধ্যেই স্থূলতা ও ওজনাধিক্যে ভুগছে। এরাই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হূদেরাগের ঝুঁকির মধ্যে আছে।
কায়িক শ্রমহীনতা এই স্থূলতা, ওজনাধিক্য ও ইনসুলিন অকার্যকারিতা শতগুণ বাড়িয়ে তুলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে। গাড়ি, লিফট ও চলন্ত সিঁড়ির ব্যবহার আমাদের হাঁটাচলাকে সীমিত করে আরাম-আয়েশের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছে বটে, কিন্তু বাড়িয়ে দিয়েছে রোগবালাই। কম্পিউটার, মুঠোফোন, আইপ্যাড আর টেলিভিশন সারা বিশ্বকে নিজের ঘরের ভেতর বা হাতের মুঠোয় এনে দিলেও কেড়ে নিয়েছে অবারিত সবুজ মাঠ, কাদা-পানিতে ফুটবল খেলা, এক্কাদোক্কা আর কানামাছি খেলা বা শীতকালে নেট টানিয়ে পাড়ার ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার দিনকে। আজকের শিশু-কিশোর সারা দিন স্কুলে বা শিক্ষকের বাসায় কাটিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকে হয় কম্পিউটার খুলে বসে, না হয় টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে জাংকফুড খায়। ভাড়াবাড়িতে খোপের মতো স্কুল বা অ্যাপার্টমেন্টের ১৭ তলার বাসা—কোনোখানেই তার জন্য খেলাধুলার অথবা দৌড়াদৌড়ির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সে তার জগৎকে সীমিত করে এনেছে হাতের মুঠোফোন বা ল্যাপটপে। নেই পাড়ায়-পাড়ায় ছোটদের খেলার জায়গা; পার্ক ও স্কুলে একটা ন্যূনতম খেলার মাঠ। বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রায় উঠেই গেছে। বছরের শুরুতেই হরেক রকম ক্লাস টেস্ট আর পরীক্ষার ধাক্কা। ক্যালরি গ্রহণ আর ক্যালরি পোড়ানোর এই দারুণ অসামঞ্জস্য হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে ঠেলে দিচ্ছে ভয়ংকর ঝুঁকির দিকে।
আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করুন
শিশু-কিশোর আর তরুণ-যুবাদের এ রকম ঝুঁকির মধ্যে রেখেই আজ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তারুণ্য, তরুণ সমাজ। তরুণেরাই এগিয়ে নেবেন বাংলাদেশকে। বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এই তরুণেরাই আমাদের পথ দেখাবেন—এ কথা সবাই বিশ্বাস করে মনে-প্রাণে। কিন্তু আজকের শিশু-কিশোর আর তরুণদের জন্য একটা স্বাস্থ্যকর ও সুস্থ পরিবেশ আমরা দিতে পারছি কই! অভিভাবক, সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্র—সবাই মিলে তাদের ঠেলে দিচ্ছি ভয়ানক সব রোগবালাই আর মহামারির দিকে। আমাদের সব উদ্যম, কর্মস্পৃহা ও উদ্দীপনা যে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বহন করে চলেছে, তাকে রুখতেই হবে। রক্ষা করতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে—এর কোনো বিকল্প পথ নেই।
সবার জন্য সঠিক পরিবেশ
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে সবার জন্য সঠিক পরিবেশ: ডায়াবেটিস থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করুন। কিন্তু কেমন ও কী এই সঠিক পরিবেশ? কীভাবে আমরা আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারি? তার জন্য চাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা, গড়ে তুলতে হবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অভ্যাসের বিপরীতে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন, তার সঙ্গে অবশ্যই চাই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও সমর্থন। ডায়াবেটিস এবং এর প্রতিরোধ বিষয়ে নিজেই শিক্ষিত ও সচেতন হোন।
নিজেই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠুন। জেনে নিন সঠিক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ মানে হলো:
স্কুল-কলেজে খেলার মাঠ ও খেলাধুলা-শরীরচর্চা বিষয়কে বাধ্যতামূলক করা
মানুষের হাঁটাচলার উপযোগী নিরাপদ রাস্তা, ফুটপাত, পার্ক, ওয়াকওয়ে ইত্যাদি নিশ্চিত করা
প্রত্যেক আবাসিক এলাকায় খানিকটা সবুজ মাঠ ও খোলা জায়গা শিশু-কিশোর, বয়স্ক ও বৃদ্ধ সবার জন্য বরাদ্দ রাখার ব্যাপারে এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বাড়ানো
বহুতল ভবন বা ঘিঞ্জি এলাকায় ভবনের ভেতর শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের সুব্যবস্থা রাখা
ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে শিশু-কিশোর ও অভিভাবক সবাইকে সচেতন করে তোলা
খাদ্যপণ্যের প্যাকেটের গায়ে ট্রান্স ফ্যাট, চর্বি ও শর্করার পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণ সম্পর্কে সচেতনতামূলক নিবন্ধ স্কুল পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা
ডায়াবেটিসের কুফলের বিরুদ্ধে সামাজিক নেটওয়ার্ক, যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, টেলিভিশন ইত্যাদির ব্যবহার।
জেনে রাখুন, আপনি ও আপনার শিশুটিও ঝুঁকির বাইরে নয় এই মুহূর্তে। আর তাই এখনই সময়-সচেতন হওয়ার, এগিয়ে আসার। নিজে সুস্থ থাকুন, আগামী প্রজন্মকেও সুস্থ রাখুন।
তানজিনা হোসেন
(হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৪, ২০১২
Leave a Reply