ডায়াবেটিস একটি মেটাবলিক বা বিপাকীয় রোগ। আর আক্রান্ত রোগীকে এ রোগ বেশ বিপাকেও (বিপদে) ফেলে দিতে পারে। ডায়াবেটিস হলে রক্তের চর্বি বা লিপিডের মাত্রা খারাপের দিকে মোড় নেয়। ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএলের পরিমাণ কমে যায় আর খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও বেড়ে যায়। এ অবস্থাকে বলে ডায়াবেটিক ডিসলিপিডেমিয়া বা ডায়াবেটিসের জন্য রক্তের লিপিডের টালমাটাল অবস্থা। এতে হূদেরাগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহু গুণ বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে রক্তের লিপিডের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
সুতরাং, ডায়াবেটিসের কারণে হূদেরাগ ও স্ট্রোকের আশঙ্কা কমাতে হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে রক্তের চর্বির মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো রক্তের চর্বির মাত্রা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। এ পরীক্ষাকে বলে ‘লিপিড প্রোফাইল’।
লক্ষ্য স্থির করতে হবে এলডিএলের মাত্রা
ডায়াবেটিস হলে রক্তে এলডিএলের মাত্রা বাড়তে থাকে। রক্তে এলডিএলের মাত্রা বেশি থাকলে তা রক্তনালির দেয়ালে জমা হয়। রক্তনালির ভেতরটা সরু হয়ে যায়। এর ভেতর দিয়ে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। হূৎপিণ্ডের রক্তনালি সরু হয়ে গেলে হূৎপিণ্ডের পেশি প্রয়োজনের তুলনায় কম রক্ত পায়। এতে হূদেরাগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে হলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই সুস্থতার জন্য রক্তে এলডিএলের মাত্রা কমানো প্রয়োজন। প্রতি ডেসিলিটার রক্তে বা প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে এলডিএলের মাত্রা ১০০ মিলিগ্রামের কম হওয়া উচিত। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ৭০ মিলিগ্রামের কম থাকলেই ভালো। রক্তে এলডিএলের মাত্রা কম রাখতে পারলে হূদেরাগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যায়।
এইচডিএলের মাত্রা
ডায়াবেটিস হলে রক্তে এইচডিএলের মাত্রা কমতে থাকে। এইচডিএলের কাজ রক্তনালির দেয়াল থেকে জমে থাকা খারাপ কোলেস্টেরলকে সরিয়ে দেওয়া। তাতে রক্তনালির ভেতর দিয়ে সহজেই রক্ত প্রবাহিত হতে পারবে। তাই রক্তে এইচডিএলের মাত্রা কমে গেলে তা বাড়াতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে এইচডিএলের মাত্রা ৪০ মিলিগ্রামের বেশি আর নারীদের ক্ষেত্রে ৫০ মিলিগ্রামের বেশি থাকা প্রয়োজন। যত বেশি থাকে, তত বেশি ভালো। যদি ৬০ মিলিগ্রামের বেশি থাকে, তাহলে তা হূদেরাগ প্রতিরোধে কার্যকর বলে বিবেচনা করা হয়।
ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা
ডায়াবেটিসে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও বেড়ে যায়। এর মাত্রা বেড়ে গেলে এলডিএলের মতোই তা রক্তনালির দেয়ালে জমা হয়। ফলে রক্তনালির ভেতরটা সরু হয়ে যায়। রক্তনালির দেয়াল শক্ত হয়ে যায়। সরু রক্তনালির ভেতর দিয়ে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। হূদেরাগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সুতরাং, রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে হবে। প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ১৫০ মিলিগ্রামের কম হওয়া উচিত। তাতে হূদেরাগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমবে।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে রক্তের লিপিডের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায় হচ্ছে তিনটি মূলমন্ত্র:
শৃঙ্খলা
সব সময় কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে আছে: নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত ও সময়মতো উপযুক্ত খাবার আর ওষুধের প্রয়োজন পড়লে নিয়মিত ওষুধ সেবন বা ইনসুলিন গ্রহণ।
খাবারদাবার
শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। আঁশসমৃদ্ধ খাবারদাবারও বেশি খাওয়া উচিত। রিফাইন্ড শর্করা কম, অরিফাইন্ড শর্করা পরিমাণমতো খেতে হবে।
ওষুধ
ওষুধের প্রয়োজন পড়লে মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে হবে। আর ইনসুলিন ইনজেকশন দরকার হলে ইনসুলিন নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শমতো। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে রক্তের লিপিডের মাত্রা সঠিক রাখার চেষ্টার পাশাপাশি এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমানো ও এইচডিএলের মাত্রা বাড়ানোর উপায় অবলম্বন করতে হবে। আর এসব করা যায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর মাধ্যমে:
খাবারে চর্বি গ্রহণে সতর্কতা
রান্নায় তুলনামূলক কম তেল-চর্বি ব্যবহার করা। কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার কম খাওয়া। স্যাচুরেটেড তেল, ট্রান্সফ্যাট কম খাওয়া; আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি খাওয়া।
নিয়মিত ব্যায়াম করা
সপ্তাহে পাঁচ দিন প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে দ্রুতলয়ে হাঁটা। বাড়িঘরের দৈনন্দিন কাজ নিজ হাতে করা। লিফটে নয়, হেঁটে সিঁড়িতে ওঠা। গন্তব্যে পৌঁছার একটু আগে রিকশা বা ট্যাক্সি থেকে নেমে বাকি পথ হেঁটে যাওয়া বা বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা, ট্যাক্সিতে না উঠে একটু দূরে হেঁটে গিয়ে ওঠা—এসবের মাধ্যমেও বেশ ব্যায়াম হবে। ভালো কোলেস্টেরল বাড়বে, খারাপ কোলেস্টেরল কমবে।
শরীরের ওজন কমানো
ধীরে ধীরে শরীরের ওজন কমিয়ে স্বাভাবিক রাখা। এর ফলে শরীরের চর্বি কমবে, কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক থাকবে।
আঁশযুক্ত খাবার
যেমন-শাকসবজি, লাল আটা, লাল চালের ভাতজাতীয় খাবার খাদ্যতালিকায় বেশি রাখা; খাদ্যের আঁশ রক্তের চর্বির মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে খুবই কার্যকর।
ধূমপান পরিহার করা
ধূমপান না করলে তাও রক্তের চর্বির মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক হবে।
মো. শহীদুল্লাহ
যথাসম্ভব লিফট পরিহার করে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠুন, নিজের অজান্তেই হয়ে যাবে ব্যায়াম
অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৭, ২০১২
Leave a Reply