একহারা শরীর এখন চায় সবাই। চায় শরীর থেকে বাড়তি ওজন ঝরাতে। সে জন্য ব্যায়াম করতে চায় অনেকে। আরও কারণ আছে। হূদেরাগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস থেকে দূরে থাকতে ব্যায়াম বড় সহায়। রক্তচাপ কমাতে, কোলেস্টেরল কমাতেও ব্যায়াম উপকারী। হাড় মজবুত রাখতেও চাই ব্যায়াম। সুস্থ-সজীব বার্ধক্যের জন্যও ব্যায়াম সহায়।
কিন্তু অলস মানুষদের জন্য ব্যায়ামের তাগিদ যথেষ্ট বলে মনে হয়? প্রণোদনাগুলো তত কার্যকর নয় অলস মানুষদের জন্য, বলেন বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকান গবেষণা তা-ই বলে।
অনেক বছর ধরে মানুষকে ব্যায়াম সম্পর্কে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তা হলো নিয়মিত ব্যায়াম ওজন কমানোর জন্য প্রয়োজন, গুরুতর রোগ প্রতিরোধে এবং সজীব বার্ধক্যের জন্যও প্রয়োজন। অনেকেই অবশ্য এই লক্ষ্য অর্জনকে মূল্য দেন।
কিন্তু বেশ কিছু আমেরিকান, যাঁদের মধ্যে অনেকে স্থূল, তাঁরা ব্যায়াম করার এসব প্রণোদনায় উৎসাহিত হন না।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য, ওজন হ্রাস ও দেহের ভবিষ্যৎ গড়ন নিয়ে আশা ও ভাবনা প্রণোদনা হিসেবে যথেষ্ট নয় অনেকের জন্য। বরং বর্তমান স্বাস্থ্য ভালো থাকা, সুখ—এসব কিছুর উন্নতির জন্য ব্যায়ামকে উপস্থাপন করতে পারলে তা বেশ উৎসাহিত করে অনেককে।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওমেন ও জেন্ডার’ নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন বিজ্ঞানী মিশেলে এল সেগার বলেন, জনগণের দৈনিক জীবনযাপনের সঙ্গে ব্যায়ামকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারলে কাজ হতে পারে। ডা. সেগার বলেন, ব্যায়ামের সুফল সুদূরপ্রসারী হলে এবং এর প্রভাব তাৎক্ষণিক না পেলে অনেকেই উৎসাহিত হন না। ব্যায়াম হতে হবে প্রাত্যহিক কাজেরই অংশ, জীবনাচরণ, মানুষ যেন দেখে এতে মন ভালো হয়, শরীর ভালো হয়, জীবনের গুণগত মান বেড়ে যায়।
মহিলা কর্মজীবী, যিনি কয়েক সন্তানেরও মা, এমন নারীর জন্য ব্যায়ামের কথা বলছেন ডা. সেগার। রাতের খাবারের পর তিনি তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে দ্রুত হাঁটলেন ২০ মিনিট, তাঁর ফিটনেস বাড়ল। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটল আনন্দে।
শরীর চর্চা গ্রহণ করা এবং একে চালিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ প্রণোদনা কী হতে পারে, এ নিয়ে কোনো বেশ কাজ করেছেন ডা. সেগার। প্রতি সপ্তায় ১৫০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম করার ব্যবস্থাপত্রকে সঠিক মনে করেন না তিনি। বরং জনস্বাস্থ্যকর্মীরা মানুষের সেসব মনোগত ও আবেগজনিত দিককে চিহ্নিত করতে বলেন, যা দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনেও ব্যায়ামকে অবশ্যকরণীয় মনে করে নিজেকে।
দূরবর্তী ফলাফল থেকে তাৎক্ষণিক সুফলকে মানুষ বেশি শ্রেয় মনে করে। সুখ অনুভব করা ও চাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অনেক বেশি জোর প্রণোদনা, হূদেরাগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধের দূরবর্তী লক্ষ্যের তুলনায়।
২৫২ জন অফিসকর্মীর মধ্যে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ডেভিড কে ইংগল ডিউ এবং ডেভিড মাকল্যান্ড গবেষণায় দেখেছেন, অনেকে একহারা শরীর ও ওজন হ্রাসের উপায় ব্যায়াম শুরু করলেও দীর্ঘমেয়াদি চালিয়ে যান তাঁরা। গবেষকেরা বলেন, ব্যায়ামের শরীর সব তাৎক্ষণিক ভালো লাগা ও আমেজের দিকটির দিকে বেশি জোর দেওয়া উচিত।
ডা. সেগার এভাবে বলেন, ব্যায়াম হলো জীবনসুধারস। কিন্তু এই শিক্ষা আমরা জনগণকে দিচ্ছি না। আমরা বলছি, ব্যায়াম হলো একটি দাওয়াই, একে গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে সুগার বাড়বে, কোলেস্টেরল বাড়বে, রক্তচাপ বাড়বে, ডায়াবেটিস হবে…। শরীরচর্চাকে চালিয়ে যাওয়া হলো প্রণোদনা ইস্যু, ইমোশনাল ইস্যু, মেডিকেল ইস্যু নয় ততটা।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা যায়, ব্যায়াম করা না-করা, একে চালিয়ে যাওয়া, এগুলো বয়স, জেন্ডার, গোত্র, জীবন-পরিস্থিতি—এসব কিছুর ওপর কিছুটা নির্ভরশীল বটে। যেমন কলেজপড়ুয়াদের বেলায় শরীরের গড়ন, চেহারা এসব হলো শরীরচর্চার পেছনে বড় প্রণোদনা, শরীরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ব্যায়াম শুরু আর নিয়মিত ব্যায়াম মানসিক চাপ যে উপশম হয়, এ জন্য একে চালিয়ে যায় তরুণেরা।
অন্যদিকে বয়স্ক ব্যক্তিরা ব্যায়াম শুরু করেন স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য, স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য। ব্যায়াম করতে করতে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, সঙ্গী পেয়ে যান অনেকে, একসঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার সুযোগ পাওয়া যায়, এ জন্য ব্যায়াম চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ হন তাঁরা।
অনেকে অবশ্য ব্যায়াম শুরু করেন শরীরের বাড়তি ওজন কমানোর জন্য। কিন্তু যখন প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জিত হয় না, তখন অনেক সময় ব্যায়াম ছেড়ে দেন তাঁরা। তবে এ কথাও ঠিক, খাদ্যাভ্যাসে বড় পরিবর্তন না আনলে কেবল ব্যায়াম করে তেমন লাভ হয় না। শরীরের ওজন হ্রাসকে বেশি গুরুত্ব দিলে সমস্যা এবং ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া উচিত বেশি।
‘আমি দিনে তিন মাইল হাঁটি বা সাইকেল চালাই ১০ মাইল বা সাঁতার কাটি প্রায় এক মাইল’ বলেন হেলথ কলামিস্ট জেন ব্রডি। যদি জিজ্ঞেস করেন, কেন? আমার প্রথম উত্তর হবে, ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য, এর পরের উত্তরটি হবে দীর্ঘদিন সজীব-সুস্থ হয়ে বাঁচার জন্য। তবে কেবল সে জন্য আমি কাকভোরে উঠে প্রাত্যহিক ভ্রমণের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিই না বা সাঁতার কাটার পুকুরে সাইকেল চালিয়ে যাই না।
এসব শরীরচর্চায় আমি নিজের ভেতর শক্তি অনুভব করি। প্রেরণা পাই। চাপ কম বোধ করি। অনেক বেশি উৎপাদনক্ষম মনে করি। সুখী মনে করি। ব্যায়াম করি আমি সে জন্য। কথাটি ঠিক।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৭, ২০১২
Leave a Reply