বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অতিপরিচিত রোগ। বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি। সাধারণত পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সে এই রোগ হয়ে থাকে। তাই মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বাতজ্বর নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাঁদের উৎকণ্ঠার পেছনের মূল কারণ হলো এই রোগে শিশুর হূদ্যন্ত্র আক্রান্ত হতে পারে, হার্টের ভাল্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এমনকি হার্ট ফেইলিউরও হতে পারে। তাই শরীরে বা গিঁটে একটু ব্যথা হলেই তাঁরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনেকে বাতজ্বর কি না, তা শনাক্তের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই রক্তের এএসও টাইটার পরীক্ষা করান এবং তা একটু বেশি হলেই একে বাতজ্বরের নিশ্চিত প্রমাণ বলে ধরে নেন। মনে করেন বাতজ্বর হয়ে গেছে। শুরু হয় চিকিৎসকের চেম্বারে দৌড়াদৌড়ি।
আসলে গিঁটের ব্যথা অনেক কারণেই হতে পারে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, সেপটিক আর্থ্রাইটিস, এসএলই, এমনকি ভাইরাস জ্বরের মতো সাধারণ কারণেও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া বাড়ন্ত বয়সের বাচ্চাদের গ্রোয়িং পেইন হয়। এসবের লক্ষণ যেমন আলাদা, তেমনি এর চিকিৎসাও আলাদা। অনেকেই শুধু এএসও টাইটার বেশি হলেই চিকিৎসককে বাতজ্বরের চিকিৎসা দিতে অনুরোধ করেন। দেখা যায়, বাতজ্বরের চিকিৎসা পাওয়ার জন্য তাঁরা ঘন ঘন চিকিৎসক বদল করেন।
শুধু মা-বাবাই নন, গ্রামের পল্লি চিকিৎসকেরা, এমনকি অনেক চিকিৎসকও শুধু এএসও টাইটার একটু বেড়ে গেলেই প্রতি মাসে ইনজেকশন দিতে থাকেন। অর্থাৎ অনেক চিকিৎসকও এএসও টাইটার বৃদ্ধি নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। আর এভাবেই শুরু হয় অপচিকিৎসা বা অতিচিকিৎসা।
আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত, শুধু রক্তের এএসও টাইটার বেশি হলেই তাকে কোনোক্রমেই বাতজ্বর হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই। যেকোনো সময় টনসিলের প্রদাহ, কিংবা গলা ব্যথা বা অন্য প্রকারে স্ট্রেপটোকক্কাস নামের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ইনফেকশন হলেই এএসও টাইটার বাড়বে। এর মানে হলো এএসও টাইটার বৃদ্ধি পেলে তা শুধু স্ট্রেপটোকক্কাস ইনফেকশনকেই প্রমাণ করে, বাতজ্বর নয়। আর জীবনে কখনো গলায় বা টনসিলে প্রদাহ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই যেকোনো ব্যক্তির এএসও টাইটার পরীক্ষা করালে তা এমনিতেই একটু বেশি পাওয়া যেতে পারে।
আসলে বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার ডায়াগনোসিস করার জন্য এএসও টাইটার খুব বেশি জরুরি নয়। এই রোগটি ডায়াগনোসিসের জন্য পাঁচটি মেজর বা বড় এবং অনেক মাইনর বা ছোট ক্রাইটেরিয়া আছে।
বড় লক্ষণগুলো হলো
অস্থিসন্ধির প্রদাহ, যা এক সন্ধি থেকে অন্যটিতে ছড়িয়ে যায়।
হূৎপিণ্ডের প্রদাহ, যাকে বলে কার্ডাইটিস।
ত্বকের নিচে গোটা (সাব কিউটেনিয়াস নডিউল)।
ত্বকের অংশ বিশেষ লাল হয়ে যাওয়া (ইরাইথেমা মার্জিনেটাম)।
স্নায়ুর সমস্যার কারণে মাংসপেশির নিয়ন্ত্রণহীন নড়াচড়া (যাকে বলে কোরিয়া)।
ছোট উপসর্গের মধ্যে আছে ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসা, অস্থিসন্ধির ব্যথা, ইসিজিতে পরিবর্তন, রক্তের ইএসআর বা সিআরপি বৃদ্ধি ইত্যাদি।
দুটি বড় অথবা একটি বড় ও এর সঙ্গে দুটি ছোট লক্ষণ এবং স্ট্রেপটোকক্কাল ইনফেকশনের কোনো প্রমাণাদি থাকলেই তাকে বাতজ্বর হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব।
শুধু স্ট্রেপটোকক্কাল ইনফেকশন প্রমাণ করার জন্যই এএসও টাইটার করা হয়।
বাতজ্বরের রোগীদের গলা ব্যথা, টনসিলের প্রদাহ, গলনালি বা ফেরিংসের প্রদাহের একটি সুনির্দিষ্ট ইতিহাস থাকে। এর এক থেকে তিন সপ্তাহ পর বড় বড় অস্থিসন্ধি যেমন হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, কবজি ইত্যাদি প্রচণ্ড ব্যথাসহ ফুলে যায়। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটা অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হয়ে সেখান থেকে অন্য অস্থিসন্ধিতে যায়। এর সঙ্গে আরও কিছু লক্ষণ থাকে। বুকে ব্যথাসহ বুক ধড়ফড় করা, ত্বকের সমস্যা; যেমন—ব্যথাহীন গোটা, ত্বকে বিশেষ ধরনের র্যাশ বা লালচে আভা, স্নায়বিক সমস্যা; যেমন—অস্বাভাবিক আচরণ ও হাত-পা ছোড়াছুড়ি (যাকে বলে কোরিয়া)। বাতজ্বর বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে রোগীর জ্বর নাও থাকতে পারে।
বাতজ্বরের চিকিৎসা
রোগীকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। পেনিসিলিন অথবা ইরাইথ্রোমাইসিন-জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক পূর্ণ ১০ দিন সেবন করতে হবে।
অন্যান্য চিকিৎসা
রোগের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের জন্য রোগীকে প্রতি মাসে বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন অথবা মুখে পেনিসিলিন বড়ি ১২ ঘণ্টা পরপর পাঁচ বছর অথবা ২১ বছর বয়স পর্যন্ত যে সময়টি দীর্ঘতর হয়, সে সময় পর্যন্ত ব্যবহার করতে হবে। নতুবা রোগ জটিল হয়ে হূৎপিণ্ডের ভাল্ব আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হতে পারে।
রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। শুধু এএসও টাইটার বেড়ে গেলেই বাতজ্বর হয়েছে বলা যাবে না। টাইটার স্বাভাবিক থাকলে বাতজ্বর হতে পারে না, তা-ও নয়। গলা, পিঠ, হাত ও পায়ের পাতার ছোট ছোট গিরা বাতজ্বরে সাধারণত আক্রান্ত হয় না। শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে হূদ্যন্ত্রের প্রদাহ হয় না। আর্থ্রাইটিস বেশি দিন থাকলে অথবা প্রদাহের ফলে অস্থিসন্ধি নষ্ট হয়ে গেলে বা আঁকাবাঁকা হলে বাতজ্বরের আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
এএসও সুস্থ হয়ে গেলে অস্থিসন্ধি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, শুধু হূৎপিণ্ডের ভাল্ব আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। রিউমেটিক ফিভার সম্পর্কে বলা হয় ‘ইট লিকস দ্য জয়েন্ট, কিলস দ্য হার্ট’। যেহেতু বাতজ্বরকে অবহেলা করে চিকিৎসা না করলে কয়েক বছর পরে জটিল হূদেরাগ হতে পারে বা হার্টের ভাল্বের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই রোগের শুরুতেই একে শনাক্ত করা এবং যথাযথ চিকিৎসা করা অতি জরুরি।
এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সম্পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত পেনিসিলিন-জাতীয় ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
এ বি এম আবদুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অস্থিসন্ধির প্রদাহ বাতজ্বরের একটি বড় লক্ষণ, ছবিটি প্রতীকী মডেল: তাহমিদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩১, ২০১২
Leave a Reply