যখন স্কুলে পড়তাম, বাধ্যতামূলক ছিল ড্রিল করা। খেলাধুলা করা। ফুটবল ও ক্রিকেট। ছিল খেলার মাঠ। মনে আছে শৈলেন স্যারের কথা, আমাদের ড্রিল করাতেন। স্কাউট টিচার ছিলেন আবার বিজ্ঞানও পড়াতেন।
সেসব দিন কোথায়? এখন ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে বড় বড় বইয়ের ভারী বোঝা। এত পড়া, কিন্তু কী শেখা হয়? কী শেখে তারা? বিদ্যা কেবল জোরে ঢুকিয়ে দেওয়া, কাজ হয় না তেমন। যা হচ্ছে, তা হলো, স্থূল হচ্ছে ছেলেমেয়েরা। খেলাধুলা নেই, কেবলই বসে থাকা, ফাস্টফুড ও কোমলপানীয় খাওয়া। এসব সমস্যা এককালে ছিল শিল্পোন্নত দেশগুলোয়। এখন হালে সে হাওয়া লেগেছে আমাদের মতো দেশেও। মন্দ বিদ্যা শেখা আমাদের কেন আসে, ফাস্টফুড খাওয়া আর ব্যায়াম না করা কেন ভালো লাগে! তাই স্থূল হচ্ছে টিনএজরা।
পশ্চিমা গবেষকেরা বলছেন, টিনএজরা যদি স্কুলে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে যায়, হাইস্কুল স্পোর্টস টিমের একটি খেলায়ও যদি অংশ নেয়, একাধিক হলে বেশ ভালো, তা হলে বেশি ওজন বা স্থূল হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। তাই তো ছিল। কী কুক্ষণে যে বদলে গেল সব!
গত দশকে শিশুদের মধ্যে স্থূলতা ছড়িয়ে পড়ার জন্য স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ওই সব দেশে তরুণ ও যুবকদের মধ্যে শরীরচর্চাকে প্রসারিত করার পদক্ষেপ নিয়েছিল জোরেশোরে। নতুন এই গবেষণা প্রথম প্রদর্শন করল যে স্কুলভিত্তিক ব্যায়াম ওজন বাড়াকে বেশ হ্রাস করে বটে, তবে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ সক্রিয়ভাবে করলে ফলাফল আরও ভালো হয়। শরীরচর্চার ক্লাস করে সব শিক্ষার্থী সমভাবে ব্যায়ামের মধ্যে আসে না। তবে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় অংশগ্রহণে হিতকর ফল আসে বেশি। অভিজাত আবাসিক এলাকায় দোতলা ও তিনতলা ভাগ করে বা সীমিত পরিসরে খেলার মাঠবিহীন স্কুলঘর করে বিদ্যাশিক্ষা কী হয় জানি না। এতে শরীর দুর্বল, রুগ্ণ স্বাস্থ্য, ভগ্নদেহ হয় তরুণ শিক্ষার্থীদের। তবে ব্যবসা করলেন অনেকে, তা তো বটে।
ডার্টমাউথ গিনেস স্কুল অব মেডিসিনের হুড সেন্টার ফর চিলড্রেন অ্যান্ড ফ্যামিলিসের গবেষক কিথ এম ড্রেকস বলেন, স্পোর্টস টিম বা সংস্থার অংশ হলে বাচ্চারা অবিরাম কোনো না কোনো মাঝারি বা কঠোর খেলার অনুশীলন বা খেলার মধ্যে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, স্কুলে শরীরচর্চা শিক্ষা কঠোর নয়, অনেকে এসব ক্লাস এড়িয়ে যায়, অনেক সময় শরীরচর্চা তেমন কঠোরও নয়।
বিখ্যাত জার্নাল পেডিয়াট্রিকস-এ প্রকাশিত নিবন্ধে ড্রেকস ও সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, খেলাধুলায় বেশি বেশি অংশগ্রহণ করলে, বাসে বা গাড়িতে চড়ে স্কুলে যাওয়া কমালে এর প্রভাব পড়ে শৈশব স্থূলতার ওপর। যদি সব টিনএজার প্রতিবছর অন্তত দুটো স্পোর্টস টিমে খেলে, প্রতি মৌসুমে অন্তত একটি টিমে অংশ নেয়, তা হলে স্থূলতার হার কমে ২৬ শতাংশ এবং বেশি ওজনের টিনএজদের হার কমে ১১ শতাংশ। আর সব টিনএজার যদি সপ্তাহে অন্তত চার দিন হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়, তা হলে স্থূল টিনএজদের সংখ্যা কমে ২২ শতাংশ।
অবশ্য আমেরিকাতে এক-তৃতীয়াংশ হাইস্কুল শিক্ষার্থী বেশি ওজনের বা স্থূল। সে জন্য সেখানে টিনএজদের যেকোনো রকম শরীরচর্চাকে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করার তোড়জোড় চলছে। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের পরামর্শ, স্কুলে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এক ঘণ্টা মাঝারি বা কঠোর শরীরচর্চা যেন করে। কিন্তু তা অনেকেই করে না। ‘সেফ রুট টু স্কুল’ নামের ১০০ কোটি ডলারের প্রোগ্রাম নেওয়া হলো বেশি বেশি সাইডওয়ার্ক, বাইক পথ ও পথচারীবান্ধব পথ তৈরির জন্য।
আমাদের দেশে স্থূল শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সংখ্যা জানা নেই, তবে বাড়ছে। এই প্রজন্ম কম বয়সেই নানা ক্রনিক রোগের শিকার হবে। তাই সে রকম চিন্তাভাবনা আমরাও যদি করি, ভালো হয় না? দেখা যায়, হেঁটে বা বাইকে চড়ে স্কুলে গেলে স্থূলতা অনেক কমে।
টিনএজদের ব্যায়াম ও খেলাধুলায় উৎসাহী করতে হবে। মা-বাবা নিজেরা যদি খেলাধুলা করেন, ব্যায়াম করেন, স্কুলে যদি শিক্ষকেরা উৎসাহী করেন, খেলা ও স্ট্রেটস স্কুলে যদি হয়, তা হলে কাজ হবে। সবাই যে ফুটবল বা বাস্কেটবল খেলবে তা নয়, কেউ খেলবে ক্রিকেট, কেউ নৃত্য করবে, কেউ জিমন্যাস্টিকস করবে—খেলাধুলা হলেই হলো।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩১, ২০১২
Leave a Reply