স্তনস্বাস্থ্যের ধারণা মূলত স্বাস্থ্যচেতনার একটি বিশেষ প্রয়োগ। সাম্প্রতিক কালে স্তনস্বাস্থ্যের (ব্রেস্ট হেলথ) ধারণা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এলেও এ বিষয়ে মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান বেশ প্রাচীন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ব্যবহারিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর সফল ব্যবহারের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। দেহসৌষ্ঠব ও সন্তানের মৌলিক পুষ্টির উৎস হিসেবে স্তন নারীদের কাছে অনাদিকাল থেকেই সব সমাজে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। সাম্প্রতিক কালে স্তন ক্যানসারসহ নানা রোগব্যাধির প্রকোপ যেভাবে নারীর জীবন ও মনস্তত্ত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, তা আবারও সংগত কারণে সার্বিক স্বাস্থ্যচেতনায় প্রাণসঞ্চারের পাশাপাশি স্তনস্বাস্থ্যের ধারণাকে নতুনভাবে আলোড়িত করেছে। আধুনিক গবেষণা এ বিষয়ে প্রাচীন সব ধারণাকে আরও সুসংহত ও সমৃদ্ধ করেছে।
যেহেতু নারীদের স্তন পুরো প্রজননকাল (ঋতুস্রাব শুরু থেকে রজোনিবৃত্তির মধ্যকাল) ছাড়াও গর্ভাবস্থায় ও দুধ খাওয়ানোর সময় নানা ধরনের হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাই রোগ ছাড়াও নানা উপসর্গের জন্ম হতে পারে। অসুস্থতাবোধ ছাড়াও এসব উপসর্গ ক্যানসারের ভয় জাগায়। ক্যানসারের দুশ্চিন্তা দূর করা গেলেও কখনো কখনো এসব অসুস্থতা বা উপসর্গ এমন কষ্টের সৃষ্টি করে, যা সাধারণ জীবনযাপন ও কর্মধারায় যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটায়। ব্যক্তি ছাড়াও পরিবার বা কর্মক্ষেত্র এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাস্থ্য-উদ্বেগের কারণে প্রচুর অর্থ ব্যয়ও হতে পারে।
অথচ স্তনের ক্ষেত্রে সাধারণ স্বাস্থ্যচেতনার প্রয়োগ শুধু যে প্রত্যঙ্গ হিসেবে স্তনকে সুস্থ রেখে এসব অসুস্থতা বা উপসর্গসংক্রান্ত কষ্ট থেকে রেহাই দিতে পারে তা-ই নয়, কঠিন ব্যাধির উদ্বেগ নিরসন ও ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির আগাম রোগ নির্ণয় করে তার যথাযথ প্রতিকার লাভও এক বিরাট প্রাপ্তি হতে পারে। এমন অবস্থান থেকেই স্তনস্বাস্থ্যের ধারণার সূত্রপাত। সব বয়সেই ভিন্ন ভিন্ন কারণে স্তনস্বাস্থ্য ধারণায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের প্রয়োগ রয়েছে। যেমন কিশোরী বা বয়ঃসন্ধিকালে স্তনের স্বাভাবিক বিকাশ অর্জনের মাধ্যমে স্তনের স্বাভাবিক গঠন, গড়ন ও সৌষ্ঠব অর্জন, তারুণ্যে শ্রাব-পূর্ব কষ্ট পরিহার, মাতৃত্বকালে সফলভাবে দুধ পান করানো, মাতৃত্ব অন্তর্বর্তীকালে স্তনের পরিচর্যা ও সুরক্ষা এবং পৌঢ়ত্বে ও বার্ধক্যে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির আগাম রোগ নির্ণয় করা এবং সব সময়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করাই এসব কৌশল প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য।
এই কৌশলগুলো খুবই বাস্তবসম্মত ও সহজে ব্যবহারোপযোগী। মূল কৌশল হলো সচেতনতা। স্তনকে প্রথমত নিবিড় নজরদারি বা পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। শরীরের অংশ হিসেবে জানতে হবে বয়সের সঙ্গে এর বৃদ্ধিক্রম, বিকাশ, গড়ন, গঠন ও স্পর্শানুভূতি এবং প্রজননচক্র ও বয়সের সঙ্গে ঘটতে থাকা বিবর্তন। আরও জানতে হবে মাসিক চক্রের সঙ্গে চলমান পরিবর্তনগুলো। বুঝতে হবে কী স্বাভাবিক এবং কী এর ব্যতিক্রম। এভাবেই গভীর ও একান্ত পরিচয় গড়ে তুলতে হবে নিজ স্তনের সঙ্গে। মাসে এ ধরনের একবার পর্যবেক্ষণ নিজ স্তনের স্বাভাবিকতার সঙ্গে এতটাই পরিচিত করে তুলতে পারে যে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে তা সহজেই নজর কাড়তে বাধ্য।
এই নিবিড় নজরদারি বা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো স্তনকে বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধির অধীনে আনতে হবে। খাদ্য সচেতনতার মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ, পরিহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাধারণ ব্যায়ামের সঙ্গে স্তনস্বাস্থ্যসম্মত ব্যায়াম ও স্তনের পরিচর্যাও নিয়মিত করতে হবে। এসবের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনমতো চিকিৎসকের পরামর্শের মাধ্যমে বয়সের সঙ্গে স্তনের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশ ঘটিয়ে এর স্বাভাবিক গড়ন, গঠন, কার্যকরণ ও বিবর্তন নিশ্চিত করা যায়।
তা ছাড়া দ্রুত অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করা বা আগাম রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে ভয়াবহ পরিণতি রোধ করাও সম্ভব।
এভাবেই সব বয়সের নারীরা তাদের জীবনযাপন প্রণালি, খাদ্যাভ্যাস ও ফিটনেস সম্বন্ধে স্বাস্থ্যসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ওষুধের ব্যবহার ও মাদক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করে স্তনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে।
মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
সার্জন ও সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট, ব্রেস্ট হেলথ ইনিশিয়েটিভ, উইমেনস অ্যান্ড চিলড্রেনস হসপিটাল, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩১, ২০১২
Leave a Reply