অস্ত্রোপচারের পর জোড়া লাগানো ঠোঁট ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মেয়ে শাহীন আক্তার। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে তার ভাগ্যটা একটু আলাদা। জন্মগতভাবে ঠোঁটকাটা রোগে আক্রান্ত শাহীন আক্তার। সেই শৈশব থেকেই সব কাজেই যেন বাধা আসে। সহপাঠীদের সঙ্গে ঠিকভাবে মিশতে পারে না, মিশতে গেলেই কেমন যেন আড়চোখে তাকায় সবাই। প্রতিবেশীরাও একটু অন্য চোখে দেখে শাহীন আক্তারকে। ছোটবেলা থেকেই মেয়ের এ ধরনের সমস্যায় শাহীনের মা মোসাম্মৎ রাশিদা আক্তারের চিন্তার কমতি নেই। মা হয়ে মেয়ের দুঃখটা তিনি বোঝেন। মেয়ের এ সমস্যা সারিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মা। নানা লোকের কাছ থেকে অনেক তথ্য নিয়েও খরচের অভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় না শাহীনের। কষ্টের দিনগুলো যেন আরও দীর্ঘ হয়। এসব এখন শুধুই অতীতের স্মৃতি। শাহীন আক্তারের জীবনে এখন আলো ফিরতে শুরু করেছে। আর এ আলো ফেরার পথ করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা।
১৪ সেপ্টেম্বর থেকে এ বিভাগে পোড়া ও অন্যান্য কঠিন চিকিৎসার রোগীদের পাশাপাশি জন্মগত ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসা চালু হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে এ ধরনের চিকিৎসা দেশে এ বিভাগেই প্রথমবারের মতো হচ্ছে। বিভাগটির নতুন এ চিকিৎসাতেই শাহীন আক্তারদের মতো মানুষের সাদাকালো জীবনটা একটু হলেও রঙিন হতে চলেছে। ঠোঁটকাটা রোগীর ক্ষেত্রে চার থেকে ছয় মাস ও তালুকাটা রোগীদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৪ মাস সময়ে অপারেশন করালে রোগীকে স্বাভাবিক ও সুন্দর অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এখান থেকে অপারেশন করে সাত দিনের মধ্যে সেলাই খোলা যায়। আরেকটি সুসংবাদ হলো, এ চিকিৎসা নিতে রোগীদের থাকা-খাওয়া ছাড়া আর কোনো ধরনের খরচ বহন করতে হবে না। এ কাজে সাহায্য করছে বিশ্বজুড়ে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রের দাতব্য সংস্থা স্মাইল ট্রেন। প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসা খরচ বাবদ স্মাইল ট্রেন ২৫০ মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়।
যশোরের মনিরামপুরের আবিদ রহমান, বয়স মাত্র ১০ বছর। তাকে আর শাহীন আক্তারের মতো দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। মাত্র কয়েক দিন হলো তার ঠোঁট ও তালুতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। চিকিৎসায় সেও দেখবে আলোর মুখ।
এসব বিষয়ে কথা হয় বার্ন ইউনিট, সমগ্র বাংলাদেশ ইউনিটের জাতীয় প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্তলাল সেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জন্মগতভাবে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের অনেক বঞ্চনা পোহাতে হয়। দেখা যায়, অনেক মেয়ের এ সমস্যার কারণে বিয়ে ভেঙে যায়। আবার অনেকে শারীরিকভাবে সমর্থ হয়েও কাজ পায় না। তবে একটি ছোট অপারেশনের মাধ্যমে এ ধরনের রোগীদের স্বাভাবিকভাবে নিয়ে আসা সম্ভব।’ তিনি জানান, ২০০০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় সারা দেশে এ ব্যাপারে প্রচারণা চালানো হয়। এতে দেখা যায়, গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ঠোঁট ও তালুকাটার চিকিৎসা নিয়ে কুসংস্কার প্রচলিত আছে। কুসংস্কার ভাঙতে এ বিষয়ে চিকিৎসায় ব্যাপক প্রসারের প্রয়োজন পড়ে।
‘ঠিক এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের দাতব্য সংস্থা স্মাইল ট্রেন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এতে রোগীদের বিনা মূল্যে সবচেয়ে ভালো সেবা পাওয়ার সুযোগ হয়েছে’—বললেন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম।
দেশে এফসিপিএস বা এমএস পর্বের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে হাতে-কলমে শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ঠোঁট ও তালুকাটার চিকিৎসা যোগ হওয়ায় তরুণ চিকিৎসকদের শেখার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। রোগীদের সেবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনেক বড় প্রাপ্তি।
ঠোঁট ও তালুকাটা হয় কেন
অধ্যাপক আবুল কালাম জানান, জন্মগতভাবে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীর মায়ের গর্ভকালীন সময়ে কিছু সমস্যার কারণে হতে পারে। মূলত সন্তান গর্ভাবস্থায় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও গর্ভকালীন ইনফেকশন থেকে ঠোঁট ও তালুকাটা সন্তানের জন্ম হয়। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীকে ঠিক সময়ে অস্ত্রোপচার করা গেলে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা অনেক সহজ হয়ে যায়।
চিকিৎসার যোগাযোগ: ৩১৫ ও ৪০৫ নম্বর কক্ষ, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ফোন: ০১৭৭৫২৭১১৪১।
জিয়াউর রহমান চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৪, ২০১২
Leave a Reply