অফিস কর্মকর্তা হালিমের চাকরি দূরবর্তী মফস্বল শহরে। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। গেলেন চিকিৎসকের কাছে। সব দেখেশুনে চিকিৎসক জানান, মানুষের শরীরে অনেক নার্ভ বা স্নায়ু আছে, তাদের নামকরণও করা হয়েছে। এর মধ্যে সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভের নাম ফেসিয়াল নার্ভ, যা মস্তিষ্ক থেকে তৈরি হয়ে, হাড়ের ভেতরে টানেলাকৃতি জায়গা পেরিয়ে কানের পেছন দিয়ে এসে মুখমণ্ডলে পাঁচটি শাখার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মুখমণ্ডল, চোখের পাতা ও কপালের মাংসপেশির নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি এই স্নায়ু জিহ্বায় স্বাদের নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত শব্দ কানে ঢুকতে বাধা দেয়। এই নার্ভের মাধ্যমেই মুখমণ্ডলের মাংসপেশি নড়াচড়ার মাধ্যমে সুন্দর হাসি বা বেদনার অভিব্যক্তি তৈরি করে। যদি কোনো কারণে প্রদাহের ফলে নার্ভটি ফুলে যায়, তখন টানেলের ভেতরে থাকা অংশ খুব চাপের মধ্যে পড়ে দুর্বল বা অকার্যকর হলে এ রোগ দেখা দেয়।
কেন এই সমস্যা?
বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে কারণ জানতে পারা যায় না। তবে জ্বর, ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি, কান পাকা, ভাইরাস-সংক্রান্ত প্রভৃতি কারণে নার্ভের প্রদাহ হয়ে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে এটি দুর্বল হওয়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। কারণ হিসেবে প্রধানত হারপিস জোস্টার ভাইরাসকে চিন্তা করা হয়। এ ছাড়া মাথায় আঘাত লাগা, ডায়াবেটিস, ব্রেন টিউমার, ব্রেন স্টেম স্ট্রোক, মাল্টিপল স্কেলোরোসিস—ইত্যাদি কারণেও একই রকম রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
রোগের লক্ষণ
রোগের পূর্ব লক্ষণ হিসেবে গা ম্যাজ ম্যাজ করা, খাবারে স্বাদ না পাওয়া, বমি বমি ভাব বা ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে। যে দিকের নার্ভ কাজ করে না, সেদিকের মুখ ও কপালের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যায়, চোখ বন্ধ হয় না এবং যেদিকে আক্রান্ত হয়, মুখমণ্ডল তার বিপরীতে বেঁকে যায়। দুর্বল দিক দিয়ে খাবার ও পানি মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। এ রোগ সাধারণত মুখমণ্ডলের এক দিকে আক্রান্ত হয়, কিন্তু ১ শতাংশ ক্ষেত্রে দুই দিকই আক্রান্ত হতে পারে। চোখ খোলা থাকে, চোখের পানি অনেক সময় শুকিয়ে যায়। এ কারণে চোখের ভেতরে ধুলাবালু ঢুকে চোখের মণিতে বা কর্নিয়ায় ইনজুরি হতে পারে। অনেক সময় রোগী আক্রান্ত দিকের কানে বেশি শুনতে পায়, পাশাপাশি মুখমণ্ডল অবশ লাগা, শিরশির করা ও হালকা মাথাব্যথা থাকতে পারে। লক্ষণ দিয়েই মূলত রোগ নির্ণয় করা যায়। পরবর্তী সময় জিহ্বায় স্বাদ না পাওয়া ও মুখের মাংসপেশিতে খিঁচুনি হতে পারে। কোনো কোনো রোগীর খাবার চিবাতে গেলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। একে ক্রোকোডাইল টিয়ার সিনড্রোম বা কুমিরের কান্না বলা হয়।
এই রোগ একজন থেকে অন্য জনে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে।
রোগের স্বাভাবিক গতি—বেলস পলসি হঠাৎ করেই শুরু হয়। রোগ শুরু থেকে প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা দেখা যায়। এককথায় এ রোগের অগ্রগতি আশাপ্রদ। সাধারণত ৮৫ শতাংশ রোগী তিন সপ্তাহের ভেতর ভালো হয়ে যায়। অবশিষ্ট রোগীর বেশির ভাগই আট সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি লাভ করে। তবে প্রথম আট সপ্তাহের মধ্যে ভালো না হলে কিছু দুর্বলতা থেকে যায়। ১০ বছরের কম বয়সে ও ৬১ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।
রোগ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
রোগ লক্ষণের উপস্থিতি;
ওপরে উল্লিখিত অন্য কোনো রোগের আশঙ্কা না থাকা;
চামড়ায় কোনো ফোসকা বা লালচে দাগ না থাকা;
নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষায় অন্য কোনো সমস্যা না থাকা।
চিকিৎসার জন্য নিয়ম মানা ও ব্যায়াম করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
চোখের যত্নে চোখে ড্রপ দেওয়া, রাতে ঘুমানোর সময় চোখে মলম দিয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখা ও সাইডগার্ডযুক্ত কালো চশমা ব্যবহার করতে হবে।
মুখগহ্বরের যত্নের জন্য প্রতিবার খাওয়ার পর আঙুল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে এবং মাউথওয়াশ দিয়ে মুখ কুলকুচা করতে হবে। সঙ্গে কোনো ইনফেকশন থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
দেখানো উপায়ে মুখের ব্যায়াম করতে হবে। প্রয়োজনে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ফিজিওথেরাপি দিতে হবে। সুযোগ থাকলে বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া ও চুইংগাম চিবানো যেতে পারে।
ওষুধের ভেতরে প্রেডনিসোলোন নামক স্টেরয়েড ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০০৯ সালে সুলিভান নামক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ প্রদাহ নিরাময়ে কিছুটা কার্যকর হলেও অ্যান্টিভাইরাল (এসাইক্লোভির-জাতীয়) ওষুধ খুব বেশি কার্যকর নয়। এর সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ও নিউরো ভিটামিন দেওয়া যেতে পারে। ব্যথা হলে বেদনানাশক ব্যবহার করতে হবে।
সুদীপ্ত কুমার মুখার্জি
নিউরো সার্জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৭, ২০১২
Leave a Reply