একজন অজ্ঞান রোগী, একজন অসহায় মানুষ—তিনি হতে পারেন আপনার প্রিয়জন, নিকটস্থ যে কেউ, আবার অচেনা। পরিচয় যা-ই হোক না কেন, আপনার মমত্ববোধ, আপনার দায়িত্ব ও একজন মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতার কারণে আপনাকে অবশ্যই কিছু না কিছু করতে হবে। কেউ আপনার সামনে রাস্তায় অজ্ঞান হতে পারে আবার কেউ বা বাড়িতে—যেখানেই হোক না কেন, দয়া করে দূরে সরে যাবেন না, এগিয়ে আসুন, কাছে যান। কাছে গিয়ে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, অজ্ঞান রোগীর অজ্ঞানের অবস্থার মাত্রা নিরূপণ করা।
প্রথমেই রোগীর নাম ধরে ডাকুন আর নাম না জানা থাকলে একটু ভরাট ও দরাজ কণ্ঠে বলুন, এই যে মা, বাবা, চাচা, চাচি, ভাই বা বোন একটু চোখ খুলে তাকান তো দেখি। এর মাধ্যমে কখনো দেখবেন রোগী একটু চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে, আবার কখনো চোখ না খুলেই গোঙানির স্বরে বলছে, আমি কোথায়? আবার কখনো বা কোনো ধরনের সাড়া দিতেই ব্যর্থ হচ্ছে। রোগীর নাকের কাছাকাছি একটি হাত নিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করুন, শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না। শ্বাস-প্রশ্বাস চলার ব্যাপারটি বুকের ওঠানামা দেখে এবং নিশ্বাসের শব্দ শুনেও বুঝতে পারা যায়। ঠিক এ অবস্থায় আপনাকে কয়েকটি কাজ একসঙ্গে করতে হবে।
প্রথমত, নিকটস্থ সার্বক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়, এমন একটি সেন্টারে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করুন (সবার ফোনের অ্যাডড্রেস-বুকে এক বা একাধিক অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর রাখা উচিত)।
দ্বিতীয়ত, জোরে চিৎকার করে আশপাশের লোকজনকে সাহায্যের জন্য ডাকুন।
এবং সর্বশেষ আপনি আপনার নিজের সামর্থ্যমতো পূর্ব-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রোগীর সাহায্যের জন্য কিছু কাজ করবেন।
রোগীকে সোজা করে শুইয়ে দিন। এ সময় অবশ্যই রোগীকে কাত করে রাখতে হবে। চিত বা উপুড় করে রাখলে রোগীর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। গায়ে শক্তভাবে আটকানো কোনো পোশাক থাকলে তা ঢিলা করে দিন। মনে রাখবেন, শক্ত করে আটকানো একটি বেল্ট বা বক্ষবন্ধনীর জন্য রোগীর শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
কোনোভাবেই উঠিয়ে বসানো যাবে না। এ অবস্থায় কোনো খাবার দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। বরং সম্ভব হলে আপনার নিজের আঙুলে রুমাল জড়িয়ে রোগীর মুখে জমে থাকা লালা বের করে দিতে হবে। মাথা পেছনের দিকে কাত করে ধরে থুতনি একটু উঁচু করে ধরুন।
এ সময় খিঁচুনিও থাকতে পারে। খিঁচুনি হলে হাত-পায়ের কাছ থেকে আঘাত লাগতে পারে, এমন সবকিছু সরিয়ে নিন। দয়া করে খিঁচুনির রোগীকে জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করবেন না। দ্রুত একপাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিন।
পাশাপাশি রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনুন, যেমন—আগুন থেকে দূরে নেওয়া, চলমান রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গেলে রোগীকে রাস্তার পাশে নেওয়া, লিফটে অজ্ঞান হওয়া রোগীকে লিফটের বাইরে আনা, বাথরুমে অজ্ঞান হওয়া রোগীকে বাইরে আনা প্রভৃতি কাজ করতে হবে।
এ অবস্থায় রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে মুখের লালা পরিষ্কার করার পাশাপাশি খেয়াল করে দেখুন, দাঁত ও জিহ্বার অবস্থান কী। যদি জিহ্বা দাঁতের মাঝে আটকা পড়ে অথবা জিহ্বা পেছনের দিকে গিয়ে শ্বাসনালির মুখ আটকে দেয়, তা হলে একটি চামচের উল্টো দিক দিয়ে দাঁতের পাটিকে খুলে রাখা ও জিহ্বাকে যথাস্থানে রাখা সম্ভব। নকল দাঁত থাকলে খুলে রাখুন, যদিও এ কাজের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এ পরিস্থিতিতে একটু জেনে নিই, কেন একজন মানুষ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
স্ট্রোক, অ্যাকসিডেন্ট ও মাথায় আঘাত, এপিলেপ্সি বা মৃগী
হার্ট অ্যাটাক, হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া
ডায়াবেটিস থেকে সুগার কমে অথবা বেড়ে যাওয়া, রক্তে লবণের তারতম্য
খুব বেশি জ্বর
নেশার দ্রব্য বা বেশি মাত্রায় ওষুধ খাওয়া, সাপের কামড়, বিষক্রিয়া
বজ্রপাত ও ইলেকট্রিক শক, হিটস্ট্রোক
থাইরয়েডের বা পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের সমস্যা, লিভার বা কিডনি ফেইলর
বিষাক্ত গ্যাসের সংক্রমণ (দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা গর্তে কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস জমে থাকে, সেখানে কেউ ঢুকলে এ ধরনের বিপদে পড়তে পারেন)
হঠাৎ হার্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (সাডেন অর্থ হঠাৎ, কার্ডিয়াক অর্থ হূৎপিণ্ড আর অ্যারেস্ট হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া) এটি একটি অতি জরুরি অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেওয়া অতি জরুরি। তবে আমাদের দেশে অনেকের ভেতরে এ সম্পর্কে এক বিভ্রান্তি কাজ করে। এ অবস্থায় রোগী মারা যাওয়ার পর অনেকে বলে থাকেন, রোগীকে বুকে চেপে মেরে ফেলা হয়েছে, বাস্তবে কি তাই? কথাটা একটুও ঠিক নয়, বরং যে ব্যক্তি বুকে চেপে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিয়েছেন, তিনি অনেক ধন্যবাদ পেতে পারেন। এ বিপদে এটাই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা। এবং সময়মতো অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এই প্রচেষ্টার জন্য অনেকেই বেঁচে যেতে পারেন। আসুন, এ অবস্থায় কর্তব্যরত ব্যক্তিকে সঠিক চিকিৎসা প্রদানে আমরা আরও সাহায্য করি।
যদি জানা থাকে রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তা হলে দেরি না করে মিষ্টি কিছু খাইয়ে দিন। তবে গ্লুকোজ বা চিনির পানি খাওয়ানোই সবচেয়ে ভালো।
আগে থেকেই আপনি যদি রোগী সম্পর্কে জানেন এবং রোগী পরিচিত হয়, তা হলে হাসপাতালে দরকার হয়, এমন সব ওষুধ এবং আগের চিকিৎসার কাগজপত্র একটি ব্যাগ বা ফোল্ডারে নিয়ে নিন। নিকটস্থ আত্মীয়স্বজনকে ফোন করুন।
সুদিপ্ত কুমার মুখার্জি
নিউরোসার্জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১২
Leave a Reply