যদি শব্দদূষণের কারণে রোগীর শ্রুতির যথার্থতা হ্রাস পায়, তাকে বলা হয় শব্দজনিত শ্রুতিহ্রাস। এটি একটি অসুস্থতা।
নয়েজ বা শব্দদূষণ: যে শব্দ শারীরিক ও মানসিক আঘাত সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির বিরক্তি উৎপাদন করে, তাকে নয়েজ বা শব্দদূষণ বলা হয়।
শব্দদূষণের ফল: ক. কানের
ক্ষণস্থায়ী শ্রুতি হ্রাস: কনসার্ট বা মাইকের শব্দ শোনার পর ঘটতে পারে।
স্থায়ী শ্রুতি হ্রাস: যদি ক্ষণস্থায়ী শ্রুতি হ্রাসের কারণটি বারবার ঘটতে থাকে অথবা আক্রান্ত হওয়ার একটি মাত্র ঘটনা থেকেও স্থায়ী শ্রুতিভ্রংশ হতে পারে। এতে শ্রবণশক্তি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে না।
অন্যান্য প্রতিক্রিয়া: অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের উত্তেজনা এবং নর-অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণের ফলে—মানসিক পীড়ন, অভিনিবেশের সমস্যা, অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ, ক্লান্তি। দ্রুত হূৎকম্পন, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, গর্ভস্থ শিশুর সমস্যা।
শব্দজনিত আঘাত: একক এবং তীব্র শব্দের জন্য তাৎক্ষণিক শ্রুতি হ্রাস ঘটতে পারে, যেমন—বিস্ফোরণ, বন্দুকের গুলি অথবা শক্তিশালী পটকার শব্দ।
রাইফেল বা বন্দুকের গুলির শব্দমাত্রা থাকে ১৪০ থেকে ২৭০ ডেসিবেলের মধ্যে। আকস্মিক উচ্চমাত্রার শব্দ আউটার হেয়ার সেল এবং রিজনারস মেমব্রেনের ক্ষতি করতে পারে। এরা হচ্ছে অন্তঃকর্ণের বিভিন্ন অংশ। পরিপাকীয় এবং গঠনগত দুই ধরনের ক্ষতির শিকার হয় কোষগুলো। ফ্রি রেডিকেলজনিত ক্ষতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরিপাকজনিত রূপান্তর ঘটলে ক্ষণস্থায়ী এবং গঠনগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে স্থায়ী শ্রুতিভ্রংশ হয়।
ক্ষতিকর শব্দের মাত্রা: কতটা শব্দ এবং কতক্ষণ ধরে শোনা হচ্ছে তার ওপর ক্ষতি নির্ভর করে। ৮৫ ডিবির চেয়ে বেশি শব্দকে ন্যূনতম ধ্বংসাত্মক শব্দ বলা হয়।
নিরাপদ শব্দসীমা: ৮৫ ডিবি শব্দের ভেতর দৈনিক আট ঘণ্টা করে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন থাকা নিরাপদ। ১০০ ডিবি শব্দ মাত্রায় প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচ দিন থাকা নিরাপদ।
শব্দদূষণের উৎস: আধুনিক যন্ত্রপাতি— হাইড্রোলিক হর্ন, জেট ইঞ্জিন, নির্মাণকর্ম ও কনসার্ট।
সামাজিক শব্দদূষণ—ট্রাফিক হর্ন, গার্হস্থ্য খেলনা ও মাইকিং। শিল্প কারখানার শব্দদূষণ। ট্রাফিকজনিত শব্দদূষণ।
উপসর্গ: কম শোনা—পুরুষ ও মধ্যবয়সীদের বেশি হয়। টেলিফোনে কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে।
শোঁ শোঁ শব্দ—ঘুম, মেজাজ ও আলাপচারিতায় সমস্যা হয়। কানে ব্যথা, অতি শব্দ সংবেদনশীলতা, ঘুম ঘুম ভাব, মাথাব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত ও মনোযোগের সমস্যা।
এ ছাড়া ঘাড়ে ব্যথা, কাঁধে ব্যথা ও ভীতিগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা: ব্যাখ্যা পুনর্বাসন: হিয়ারিং এইড বা কানে শোনার যন্ত্র।
প্রতিরোধ: শব্দদূষণ থেকে দূরে থাকা। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অসুখের সুচারু নিয়ন্ত্রণ ও পেশার পরিবর্তন।
ওষুধপত্র: অন্তঃকর্ণের ওপর ক্রিয়াশীল ওষুধ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অটো-টক্সিক ওষুধ বর্জন।
ইয়ার প্লাগ ব্যবহারে অতিরিক্ত শব্দ কানে ঢুকতে না দেওয়া।
যারা রিস্ক গ্রুপে আছেন, তাঁদের নিয়মিত হিয়ারিং টেস্ট করানো।
প্রকৌশলগত ব্যবস্থা নিয়ে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতির শব্দ উৎপাদন মাত্রা কমিয়ে আনা বা ‘নীরব’ যন্ত্রপাতির অন্বেষণ করা।
শব্দ হ্রাসে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা: আবাসিক বা নীরব এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিল্প এলাকার জন্য পৃথক পৃথক শব্দমাত্রা বেঁধে দিয়ে সরকার শব্দদূষণ রোধের চেষ্টা করে। যেমন— সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এই তিন ধরনের এলাকায় যথাক্রমে ৫০ ডিবি, ৭০ ডিবি ও ৭৫ ডিবি শব্দ অনুমোদন লাভ করে।
রাত নয়টা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত আবার এ মাত্রা ৪৫ ডিবি, ৬০ ডিবি ও ৭০ ডিবি।
ব্যক্তিগত পর্যায়ের আত্মরক্ষা: প্লাগ, ইয়ার-মাফ ইত্যাদি ব্যবহার করে ১৫ ডিবি পর্যন্ত শব্দদূষণ রোধ করা যায়।
উপসংহার: চালক যখন হাইড্রোলিক হর্ন থেকে হাত সরাবেই না, তখন পাঠক আপনাকে কানের ফুটোয় হাত রেখেই পথ চলতে হবে। যেন এক নীরব প্রতিবাদের মতো।
পরিবেশ-সচেতনতার পথ বেয়ে কিছুদিন আমাদের হয়তো এভাবে কানে হাত রেখেই চলা ভালো।
মিরাজ আহমেদ
নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২
Leave a Reply