যখন কোনো জীবাণু মানবদেহে প্রবশে করে তখন শরীরে যে অসুস্থতা দেখা দেয় তাকে রক্তদুষ্টি বলা হয়। রক্তদুষ্টির সাথে যদি কোনো অঙ্গের রক্ত চলাচল কমে যায় কিংবা তার কার্যকারিতাতে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায় তবে তাকে তীব্র রক্তদুষ্টি বলা হয়ে থাকে। যখন রক্তদুষ্টির সাথে শরীরে রক্তচাপ কমে যায় তখন তাকে রক্তদুষ্টিজনিত অবসাদ বলা হয়ে থাকে।
রক্তদুষ্টির তীব্রতা যত বাড়ে মৃত্যুহার ততই বেড়ে যায়। ম্যালেরিয়া ছাড়া অল্পসংখ্যক জীবাণুই রক্তে বংশবিস্তার করে থাকে। যখন শরীরের প্রতিবন্ধকতায় ছেদ পড়ে কিংবা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পায় তখন জীবাণু শরীরের রক্তে ঢুকে পড়ে ও রক্তদুষ্টি সৃষ্টিতে সাহায্য করে থাকে।
বাইরের দিক থেকে চমড়া ও ভেতরের দিক থেকে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী দিয়ে শরীরে আবৃত থাকে। বহিস্থ বাধার অখণ্ডতা হারালে সাধারণত বোঝা যায়, কিন্তু মুত্র নিষ্কাশনের জন্য মূত্রনালীতে নল, শিরার ভেতরে নল কিংবা শ্বাসনালীতে নল ইত্যাদি দিয়ে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ফাটল সহজে বোঝা যায় না। অনেক সময় ক্ষুদ্র ক্ষত থেকেও রক্তদুষ্টি হতে পারে। যেমন কীটপতঙ্গের কামড়, কাঁটার খোঁচা ও চামড়ায় সামান্য ক্ষত ইত্যাদি। সাধারণত খাদ্যনালী যা মুখ থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত বিস্তৃত, এমনকি যা যকৃত ও পিত্তকে অন্তর্ভুক্ত করে সেখানেও আন্তঃস্থ বাধায় ফাটল ধরে বেশি।
কোনো অসুখ রোগ জীবাণুর দ্বারা হয়েছে কি না তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হলো সেই জীবাণুকে মাইক্রোস্কোপের নিচে শনাক্ত করা বা গবেষণাগারে সেই জীবাণু উৎপাদন করা। যা হোক রোগজীবাণু গবেষণাগারে উৎপাদন করতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে এবং এদের মধ্যে অর্ধেক জীবাণু সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায় না, কেননা অনেক জীবাণু ধীরে ধীরে উৎপাদিত হয়, অনেক রোগী আগেই এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করে থাকে এবং অনেক সময় নমুনা সংগ্রহ করতে ভুল হয়ে যায়। সাধারণত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে এন্টিবায়োটিক ওষুধ শুরু করে দেয়া হয় এবং পরে গবেষণাগারে ওই জীবাণু উৎপাদন করে ও তার সংবেদনশীলতা দেখে রোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় অথবা ওষুধের পরিবর্তন করা যায়। অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এবং গবেষণাগারে উৎপাদন ছাড়াই জীবাণু শনাক্তকরণ এবং ওষুধের কার্যকারিতা সম্বন্ধে ধারণা নেয়া যায়। পিসিআর (চঈজ) নামক পদ্ধতিতে ডিএনএ (উঘঅ) সম্প্রসারণের মাধ্যমে এটি করা হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং এখনো আমাদের দেশে বহুল প্রচারিত নয়।
চিকিৎসা সাধারণত দুই ভাগে করা হয়ে থাকে সাধারণ প্রয়োজন অনুযায়ী যোগান দেয়া ও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা। নানা কারণে রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে এবং তা বেশি দেরি না করেই পূরণ করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্যালাইন দিয়ে এর অভাব পূরণ করা হয়। যখন স্যালাইন দিয়ে এর অভাব পূরণ করা না যায় তখন ইনজেকশন ব্যবহার করতে হয়। ডোপামিন জাতীয় ইনজেকশন সাধারণত ব্যবহার করা হয়। শরীরের রক্ত চলাচল কমে গেলে সময়মতো তা লক্ষ্য প্রয়োজনবোধে যন্ত্রচালিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করলে অনেক রোগী বেঁচে যাবে।
রক্তদুষ্টিজনিত অনেক রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। কেননা এসব রোগীর শ্বাসের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাংশপেশির অকার্যকারিতা দেখা দেয় যদিও ফুসফুসের কোনো প্রদাহ হয় না। কোনো কোনো রোগীর অত্যন্ত শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। মাঝে মাঝে অবসাদ কমিয়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় কমানো যায়।
অসুখের তীব্রতা কিডনির কার্যহীনতা দেখা দেয়।
সাধারণত পুষ্টি রক্ষা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে নল দিয়ে খাবার ও পানীয় দিতে হবে। রক্তদুষ্টি রোগে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় আধিক্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিনের ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে।
সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান চিকিৎসা হলো প্রচলিত জীবাণুনাশক জীবাণু ওষুধ। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসা চালু করে ফেলতে হবে। এতে মৃত্যুহারও কমে আসবে। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু না করলে মৃত্যুহার বেড়ে যাবে। বেশিরভাগ রক্তদুষ্টি গ্রাম পজিটিভ জীবাণু দ্বারা হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু রক্তদুষ্টি শ্বাসনালীতে পেটের ভেতরে কিংবা মূত্রনালীতে শুর হয়। যা হোক, প্রাথমিক অবস্থায় প্রদাহের উৎস জানা সম্ভবপর নাও হতে পারে। এন্টিবায়েটিক চিকিৎসা রোগীর সংবেদনশীলতা দেখে কিংবা স্থায়ীভাবে জীবাণুর প্রতিবন্ধকতা জেনে ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত যেসব এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতার পরিধি
বিস্তৃত সেসব এন্টিবায়েটিক ব্যবহার করতে হয়। যদি ছত্রাকজাতীয় প্রদাহের সম্ভাবনা থাকে তবে এর জন্য ওষুধ ব্যবহার করতে হবে শুরুতেই এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা না যায় তবে অন্যান্য সহকর্মীর সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি প্রথম স্তরের ওষুধ কার্যকর না হয় তবে রোগীর ভবিষ্যৎ খারাপ। যদি প্রদাহের উৎস সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ধারণা থাকে তবে যেসব এন্টিবায়োটিকের পরিধি সীমিত সেসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত।
তীব্র রক্তদুষ্টিতে শরীরে স্টেরয়েড তৈরি কম হয়। অল্প পরিমাণে হাইড্রোকর্টিসন (ঐীনড়সধসড়য়মঢ়সষপ) ৫ থেকে ১১ দিন দিলে শকের সময় কমে আসে এরবং মৃত্যুহারও কমে আসে। যেসব রোগীর এড্রিনাল গ্রন্থির কার্যকারিতা কম থাকে তাদের বেলায় উপকার বেশি পাওয়া যায়।
স্ট্যাটিন ব্যবহার করলে রক্তদুষ্টির ঝুঁকি কমে যায় এবং এতে মৃত্যুহারও কমে।
যদি রক্তদুষ্টির ক্রমবৃদ্ধি এন্টিবায়োটিক দ্বারা নিয়ন্ত্রণে না আনা যায় তবে বিভিন্ন অঙ্গের অকার্যকারিতা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন অঙ্গের অকার্যকারিতার সাথে মৃত্যু ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। মধ্যম মেয়াদে কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে কিডনির কার্যকারিতায় গোলযোগ দেখা দেয়। যাদের ক্ষণস্থায়ীভাবে কিডনির অকার্যকারিতা দেখা দেয় তাদের অনেকের ডায়ালাইসিস করতে হয়। এদের মধ্যে আবার অনেকেই পরবর্তী সময়ে ডায়ালাইসিস ছাড়াই চলতে পারে।
—————————-
ডা. এ কে এম আমিনুল হক
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন), ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ময়মনসিংহ
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৩ এপ্রিল ২০০৮
Leave a Reply