ঘুমিয়ে পড়া—জেগে ওঠা চক্র
ঘুম নিয়ন্ত্রণে একসঙ্গে জুটি বেঁধে উচ্চ কুশলতার দুটি বিষয় কাজ করে, যার কাজ হলো ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া, আবার ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা। একটি ‘এস’ ও অন্যটি ‘সি’ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া ‘এস’ ঘুমের পরিমাণ ও তীব্রতা নির্ধারণ করে। এডিনোসাইনও এ-জাতীয় ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক পদার্থ, যাদের বলা হয় সমনোজেন। এগুলোর ভাণ্ড পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে ঘুমের বিষয় জড়িত। ইনফ্যান্ট ও শিশু বয়সে এসব দ্রুত বাড়ার কারণে শিশু দিনে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না, ঘুমে ঢলে পড়ে। প্রক্রিয়া ‘সি’ ২৪ ঘণ্টাব্যাপী ঘুমানোর সময়কাল ও ঘুম-জাগরণের ঢেউ নিয়ন্ত্রণ
করে। এর প্রধান ঘড়িটা মগজের ভেনট্রাল হাইপোথ্যালামাস অংশের ‘এসসিএন’ নিউক্লিয়াসে বসে থেকে হূদ্যন্ত্র, রক্ত সরবরাহ তন্ত্র, হরমোন, কিডনি ও ফুসফুসে ছড়ায় এবং এগুলোকে প্রভাবিত ও বশীভূত করে কর্মযজ্ঞ সাজায়। ‘সিকারডিয়ান’ ঘড়ি আসলে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়ের কাঁটা ধরে সাজানো থাকে। তাই এর মধ্যে থেকে কাজ করার জন্য তাকে প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্বারস্থ হতে হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আলো-আঁধারি’ পরিবেশ।
নিদ্রা ঘনঘোর
গভীর ঘুমের দুটি সময় আছে, বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা এবং রাতের শেষ প্রহর তিনটা থেকে ভোর পাঁচটা। তেমনিভাবে সতর্ক জেগে থাকার সবচেয়ে ভালো সময়কাল হলো দুটো, একটা মধ্যদুপুর, অন্যটা বিকেল। অর্থাৎ, চোখজুড়ে প্রচণ্ড ঘুমস্রোত নেমে আসার পূর্বক্ষণ, যার অন্য নাম ‘দ্বিতীয় ঘুমঝড়’।
ঘুমের নীতিমালা
স্লিপ ফিজিওলজির আরেকটা নীতিমালা হলো কম ঘুমের খেসারত সুদ-আসলে মিটিয়ে নেওয়া। ঘুমে ব্যাঘাত জমতে জমতে ঘুমের মূল্যে ঋণ করে চলে দীর্ঘদিন, যা পরবর্তী সময় অবশ্যই ফেরত পেতে চায় স্ব-উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে। যেমন—দিবানিদ্রায় কাতর করে দিয়ে, দিনের মনোযোগ বিলুপ্ত করে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও মাইক্রো ঘুম ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে। সর্বদা ঘুমে আচ্ছন্নভাব, নিরতিশয় ক্লান্তি, ঘন ঘন হাই ওঠা, বিগড়ানো মেজাজ, হতাশ ভাব, মুডের সদা পরিবর্তন, ক্রুদ্ধতা, শিরঃপীড়া, মাংসপেশিতে ব্যথা, লেখাপড়ায় খারাপ করা, স্কুলে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া—এসব উপসর্গ তৈরি হয় ভালোমতো ঘুমাতে না পারায়।
ঘুমের চরিত্র (০-২ মাস)
নবজাতক ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১০ থেকে ১৯ ঘণ্টা ঘুমাবে, প্রি-ম্যাচিওর শিশু খানিকটা বেশি। বুকের দুধ পানের শিশু একনাগাড়ে এক থেকে তিন ঘণ্টা ঘুমায়, অন্যদিকে, ফর্মুলার শিশু দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা একনাগাড়ে ঘুমায়। এক থেকে দুই ঘণ্টা জেগে থাকার বিরতি থাকে মাঝখানে। দিন-রাতে সমান হারে ঘুমায় বিশেষত প্রথম সপ্তাহ। পরে সাধারণত রাতে সাড়ে আট ঘণ্টা এবং দিনে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মতো ঘুমায়।
এ সময়ে বাচ্চার ঘুমানো নিয়ে মা-বাবার ধারণার সঙ্গে পূর্ব পরিচয় না থাকায় অনেক অনুযোগ তৈরি হয়। তবে অতিরিক্ত কান্না, অস্থিরতা, নবজাতকের পেটব্যথা, জি-ই রিফ্লাক্স, ফর্মুলা খাবারের প্রতিক্রিয়ায় ঘুম নাও হতে পারে।
শিশুকে ঘুমের সময় যেন পিঠের ওপর শোয়ানো হয়, শক্ত ম্যাট্রেসে ও নরম বিছানায় নয়। বালিশ বা কমফোটারস ব্যবহার নিষেধ। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশুর বুক ও মাথা ঢাকা না থাকে।
ইনফ্যান্ট (২-১২ মাস)
মোট ঘুমের পরিমাণ ২৪ ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টার মতো। রাতে নয় থেকে ১০ ঘণ্টা এবং দিনে তিন-চার ঘণ্টার মতো।
ঘুমে হাত-পা কামড়ানো, মাথা দোলানো—এসব ভালো ঘুম না হওয়ার উপসর্গ বলে স্বীকৃত।
ছয় সপ্তাহ থেকে তিন মাস বয়সের শিশু ঘুমের ব্যাপ্তি দখলে নিতে পারে।
টোডলারস (১-৩ বছর)
মোট দৈনিক ঘুম ১১ থেকে ১৩ ঘণ্টা। দিনের বেলায় দুবারের ঘুমের চাহিদা কমে ১৮ মাস বয়সে একবারে পরিণত হয়।
অনিদ্রার ছাপ ফুটে ওঠে উপসর্গে।
শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশে, ভাষা ও বাক্শক্তি অর্জনে সুনিদ্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাতে ঘুমের সময় ভয় পায়।
প্রি-স্কুল বয়স (৩-৫ বছর)
রাতে নয় থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমায়। দিনে আর নাও ঘুমাতে পারে।
অনিদ্রার ফলস্বরূপ ঘুমে হাঁটা, ঘুমাতঙ্ক—এসব লক্ষণ দেখা যায়।
অনিদ্রা রোগ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
শৈশব (৬-১২ বছর)
নয় থেকে ১১ ঘণ্টার দৈনিক ঘুম।
ভালো ঘুম না হলে ঘুমে শ্বাসরোধ লক্ষণ মেলে।
টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস ঘুম হরণের প্রধান কারণ। স্কুল ফলাফলে এর প্রভাব পড়ে।
কৈশোর-যৌবন (১২ বছরের বেশি বয়সে)
গড় ঘুম সময় দৈনিক সাত থেকে নয় ঘণ্টা।
অনিদ্রার স্বরূপ ‘নারকোলেপসি’।
রাতে দেরিতে ঘুমানো, সপ্তাহ শেষে বন্ধের দিনে তা পুষিয়ে নেওয়া—এসব অস্বাভাবিক চিত্র তৈরি হয়। ফলাফল ভালো হয় না।
প্রণব কুমার চৌধুরী
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৯, ২০১২
Leave a Reply