অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা অথবা আত্মীয়স্বজন এ কথা বলে থাকেন, বাচ্চার মাথা ছোট অথবা বয়সের সঙ্গে বাচ্চার মাথার বৃদ্ধি হচ্ছে না। এ রোগ সম্পর্কে বুঝতে গেলে প্রথমেই ক্রেনিওসাইনোসটোসিস শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার। ক্রেনিও শব্দটির অর্থ হচ্ছে মাথা এবং সাইনোসটোসিস শব্দের অর্থ হাড় জোড়া লেগে যাওয়া। মাথার খুলি অনেকগুলো টুকরা টুকরা চ্যাপটা হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। একটি গিয়ার যেমন আরেকটি গিয়ারের সঙ্গে খাঁজে খাঁজে আটকানো থাকে, ঠিক তেমনি মাথার একটি হাড় আরেকটি হাড়ের সঙ্গে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম খাঁজে আটকানো থাকে, যাকে সুচার বলা হয়। এ ছাড়া তিন হাড়ের জোড়ার মাঝখানে বদ্বীপ আকৃতির ফাঁকা জায়গা থাকে, যাকে ফন্টানেলি বলা হয়। বড় দুটি ফন্টানেলি থাকে, যার পেছনেরটি ছয় মাস বয়সে এবং সামনেরটি দেড় থেকে দুই বছর বয়সে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাচ্চা কান্না করলে ফন্টানেলি ওঠানামা করে, যাকে মা-দাদিরা মাথার ধুকপুকানি বলে থাকেন। এসব সুচার এবং ফন্টানেলি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার আকৃতি বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়। যদি কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মাথার হাড়গুলো জোড়া লেগে যায়, তখন তাকে ক্রেনিওসাইনোসটোসিস বলা হয়। দুই হাজার জীবিত শিশুর ভেতরে একজনের এ রোগ দেখা যায়। এর ফলে মাথা বড় হতে পারে না, ভেতরের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এসব রোগীর মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আচার-আচরণ আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক থাকে না। মাথার ভেতরে চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে বারবার বমি হয়, দুই চোখের ভেতর দূরত্বও বেড়ে যায়। অনেক সময় একই সঙ্গে মাথার ভেতর পানিও জমতে পারে। অনেকে ধারণা করে থাকেন, বংশগতিতে এ রোগ প্রবাহিত হয়, কিন্তু এ কথার সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে করোনাল সুচার বন্ধ হয়ে গেলে মাথাটি লম্বা আকৃতির হয়। একে ডলিকোকেফালি বলা হয়, (ডলিকো অর্থ লম্বাটে গড়ন)। আবার স্যাজাইটাল সুচার বন্ধ হয়ে গেলে স্ক্যাফোকেফালি বলা হয়। এ ক্ষেত্রে মাথার আকৃতি অনেকটা নৌকার তলার মতো দেখতে হয়। কখনো কখনো মাথার আকৃতি ত্রিকোণাকৃতির হয়, তখন একে ট্রাইগোনোসেফালি বলা হয়। আবার কখনো মাথা মিনারের মতো লম্বা হতে থাকে। তখন একে বলে টাওয়ার স্কাল।
কখনো কখনো অনেকগুলো সুচার আক্রান্ত হলে ক্রুজন সিনড্রোম বলা হয়। আবার এর সঙ্গে হাত বা পায়ের আঙুল জোড়া লেগে থাকে। একে পর্টিস সিনড্রোম বলা হয়।
এ ক্ষেত্রে প্রথমত একটি উন্নত মানের ডিজিটাল এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যান অনেক সময় বোন স্ক্যানের প্রয়োজন হয়। চিকিৎসার জন্য সাধারণত অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। অস্ত্রোপচার করে জোড়া লাগা হাড়গুলো সমান্তরাল সূক্ষ্মভাবে কেটে দেওয়া হয়, যাকে রেইলরোড অপারেশন বলা হয়। তবে অপারেশন করার পরে আবারও হাড় জোড়া লেগে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিছু রোগীর পুনরায় অপারেশন প্রয়োজন পড়ে। অপারেশনের পরে মাথার আকৃতি সঠিক করার জন্য একটি হেলমেট ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার অনেক রোগীর ক্ষেত্রে জন্মগত কারণে অথবা শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালে কোনো ধরনের ইনফেকশন থাকার কারণে ব্রেনের বৃদ্ধির ব্যাহত হয় বা ব্রেন সংকুচিত হয়ে যায়। মাথা বড় হওয়ার জন্য ভেতরের ব্রেন বড় হওয়ার মাধ্যমে ভেতরের চাপ বাড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্রেন সংকুচিত হওয়া বা ব্রেন প্রসারিত না হওয়ার কারণে ভেতরের চাপ থাকে না। ফলে মাথা আর বিশেষ বড় হয় না। যদি মাথার ভেতরের চাপ বেশি না থাকে, অথবা মানসিক বৃদ্ধি না হয়, তাহলে অপারেশন করেও উল্লেখযোগ্য উপকার পাওয়া যায় না।
চিকিৎসা
রোগীর আত্মীয়স্বজন অপারেশনের ব্যাপারে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলায় দোদুল্যমান থাকেন, আদৌ অপারেশন প্রয়োজন কি না? এত ছোট বাচ্চা কি পারবে এই ধকল সামলাতে? নবজাতকের অপারেশনের জন্য ৬-১৮ মাস বয়স আদর্শ সময় হিসেবে ধরা হয়। কারণ এ সময় রোগী সহজে অপারেশনের ধকল সামলাতে পারে। তবে আধুনিক কালে এন্ডোসকোপের সাহায্যে তিন মাসেরও কম বয়সে অপারেশন করা সম্ভব। সব চিকিৎসারই ভালোমন্দ দিক আছে, অপারেশন না করালে ক্রমবর্ধমান চাপে দিনের পর দিন ব্রেনের ক্ষতি হয়। চিকিৎসার অভাবে শারীরিকভাবে বিসদৃশ আকৃতির মাথা আর মানসিক প্রতিবন্ধিতার কারণে রোগী সমাজ-সংসারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং রোগের অসুবিধা এবং অপারেশন থেকে প্রাপ্ত সুবিধা—সব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
সুদিপ্ত কুমার মুখার্জি
নিউরোসার্জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল। শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৮, ২০১২
Leave a Reply