২৪ মার্চ সারা বিশ্বের সাথে বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করা হলো। এ বছর এ দিবস পালনে বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ও ধস ংঃড়ঢ়ঢ়রহম ঞইঃ আমি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ করছি।
পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো যক্ষ্মা বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রচলিত একটি রোগ ও দ্বিতীয় ঘাতক ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত। পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে ৬০ লাখ যক্ষ্মা রোগী রয়েছে, তার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৬ লক্ষাধিক ছোঁয়াচে অর্থাৎ চিকিৎসার আওতায় না আসা পর্যন্ত যারা ক্রমাগত রোগ বিস্তার করে যাচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ নতুন যক্ষ্মা রোগীর আগমন ঘটছে এবং প্রায় ৮০ হাজার লোক এ রোগে প্রাণ হারাচ্ছে। হিসাব মতে প্রতি ২ মিনিটে ১ জন করে যক্ষ্মায় মারা যায়। উন্নয়নশীল দেশের যক্ষ্মা রোগীদের প্রায় ৭৫ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ উপার্জনক্ষম বয়স।
মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামের একধরনের জীবাণু থেকে এ রোগ ছড়ায়। আক্রান্ত রোগীর কফ থেকে এ রোগের জীবাণু একজনের দেহ থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়ায়। এ রোগের কোনো নির্দিষ্ট সুপ্তিকাল নেই। আক্রান্ত রোগীর বয়স, দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জীবাণু শক্তির ওপর সুপ্তিকাল নির্ভর করে। তবে সাধারণত দেহে জীবাণু প্রবেশের এক মাস থেকে তিন মাসের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু জীবাণু প্রবেশের কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক বছরের মধ্যেও এ রোগ হতে পারে। সাধারণত যক্ষ্মা ফুসফুসে হয়; কিন্তু ফুসফুস ছাড়াও লিম্ফ গ্ন্যান্ড বা লসিকা গ্রন্থিতে, হাড়ে, জোড়ায়, মস্তিষ্কের আবরণীতে, কিডনিতে, অন্ত্রে, জরায়ুতে এমনকি ত্বকেও যক্ষ্মা হতে পারে। যক্ষ্মা রোগের জীবাণু শ্বাসনালী অথবা পরিপাক নালীর দ্বারা দেহে প্রবেশ করে। আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির সাথে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। থুথুর বড় এবং ভারী অংশগুলো মাটিতে ধূলিকণার সাথে মিশে যায়। এই ধূলিকণা মিশ্রিত থুথুর বিন্দুগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় ও সুস্থ ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে। সামান্য জ্বর ও কাশি নিয়ে যক্ষ্মা রোগ শুরম্ন হয়। এর সাথে খাবারের প্রতি অনীহা, ওজন কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম, কফ ও কাশির সাথে রক্ত যাওয়া এ রোগের প্রধান উপসর্গ। এ রোগে সাধারণত বিকেল থেকে রাতের প্রথমভাগ রোগীর শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে। যেসব রোগী তিন সপ্তাহের বেশি জ্বরে ভোগে তাদের ৩৩ শতাংশ যক্ষ্মায় আক্রান্ত। যক্ষ্মা অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাধি। তবে সব যক্ষ্মা রোগী থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। যাদের কাছ থেকে যক্ষ্মা রোগ ছড়াতে পারে তাদেরকে বলা হয় ‘ওপেন কেস’। এদের কফ থেকে সব সময়ই জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এদের সাথে চলাফেরা করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রোগীর হাঁচি-কাশির সাথে সাধারণ রোগজীবাণু বাইরে আসে। রোগীর অন্য কোনো জিনিস যেমন- থালা, গ্নাস এবং পরিধেয় বস্ত্রাদির মধ্য দিয়ে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেসব রোগীর কফ বারবার পরীক্ষার পরও কোনো জীবাণু পাওয়া যায়নি তাদের সাথে সুস্থ লোক চলাফেরা করলেও রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই। সাধারণত বুকের এক্স-রে, রক্তের ইএসআর, কফ পরীক্ষা এবং টিউবারকিউলিন বা মনটেক্স টেস্ট করে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়। বিসিজি ভ্যাকসিন ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে যক্ষ্মা প্রতিরোধ করতে পারে। যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার সময় রোগীর জন্য বিশ্রাম তেমন কোনো গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় নয়। রোগীর কফে যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া না গেলে রোগীকে আলাদা ঘরে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
যক্ষ্মা চিকিৎসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রোগী ওষুধ খাচ্ছেন, কিন্তু কিছু দিন খেয়ে আবার বিভিন্ন কারণে বন্ধ করে দিচ্ছেন। আমাদের দেশে এরকম চিকিৎসা শুরম্ন করার কিছু দিন পর বন্ধ করে দেয়ার হার ৬০-৮০ শতাংশ। এভাবে বারবার চিকিৎসা শুরম্ন এবং চিকিৎসা বন্ধ করার ফলে যক্ষ্মা জীবাণুগুলো ব্যবহৃত ওষুধের বিরম্নদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ফলে এসব ওষুধ অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশে যক্ষ্মা একটি চিকিৎসা সমস্যা। তার ওপর নতুন ধরনের এ রেজিস্ট্যান্টস জীবাণু আমাদের আরো শঙ্কিত করে তুলছে। অন্য দিকে যক্ষ্মার সাথে ঘাতক ব্যাধি এইডসের জোট বাঁধা নিয়েও আমরা চিন্তিত। এইডস যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা ব্যাহত করছে। আর একটি হিসাবে দেখা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বে যক্ষ্মা রোগ আবার বিস্তার লাভ করছে এবং বিস্তৃত হচ্ছে এইডস রোগীর সংখ্যাও। তাই এখনো আমাদের ব্যাপকভাবে সচেতন ও তৎপর হতে হবে। যাতে করে রেজিস্ট্যান্টস জীবাণু ঘটিত যক্ষ্মার বিস্তার কমিয়ে আনা যায়। তার জন্য প্রয়োজন রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পূর্ণমাত্রায় নিয়মিত ওষুধ খাবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা এবং ভালো মানের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখা।
যক্ষ্মার এ ভয়াবহতা অনুধাবন করে বাংলাদেশে যক্ষ্মার সংক্রমণ কমানোর লক্ষে এবং যক্ষ্মা যাতে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষে দ্রম্নত রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগীর দ্রম্নত চিকিৎসা এবং যক্ষ্মার সংক্রমণ রোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৯৯৩ সালে বহুল আলোচিত ডটস কার্যক্রম হাতে নেয়। এ কার্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে-৭০ শতাংশ ছোঁয়াচে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা এবং তাদের ৮৫ শতাংশ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্ত করা। ডটস কার্যক্রমে চিকিৎসার ব্যয় খুবই কম এবং যেহেতু রোগী প্রথম দুই মাস স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান অথবা সংশি্নষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে উপস্থিত হয়ে নিয়মিত ওষুধ খেতে থাকেন, তাই অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে রোগ নির্ণয় নিরাময় আশাব্যঞ্জক। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের এ কার্যক্রমে একজন নতুন যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার জন্য ৩ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে এবং যদি কোনো কারণে রোগী এমডিআর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ টাকা। তাই বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে নিয়মিত এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। তাই বিগত বছরের কার্যক্রমের সফলতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের সব জনগোষ্ঠী এ কার্যক্রমের আওতাধীন আছেন। দেশের ৬ লাখ ছোঁয়াচে রোগীর ৭০ শতাংশ বর্তমানে রোগ নির্ণয় শেষে চিকিৎসা পাচ্ছে। ফলে যক্ষ্মা আক্রান্ত ৮৪ শতাংশ রোগী রোগমুক্ত হচ্ছে এবং ছোঁয়াচে রোগীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ চিকিৎসায় সফলতা লাভ করছে।
————————–
অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিকুর রহমান
মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৬ এপ্রিল ২০০৮
Leave a Reply