গতকাল ২৬ জুন ছিল মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরে শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৪৬ লাখের বেশি। আর কোনো কোনো সূত্রমতে, এ সংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ কিশোর ও যুবক এবং নারী মাদকাসক্ত প্রায় দেড় লাখ। হাসপাতাল ও পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলোর তথ্যমতে, ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের মধ্যে এ হার আরও বেশি। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত এবং শহর থেকে গ্রামে—কোথাও থেমে নেই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার।
প্রথমত, কৌতূহলের বশে বা বন্ধুদের তাড়নায় বা সাময়িক কোনো হতাশার কারণে বা নিছক শখ ও ফ্যাশন হিসেবে প্রাথমিকভাবে কেউ মাদক গ্রহণ করে। এরপর ধীরে ধীরে তার শরীর ও মন মাদকনির্ভর হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার (একধরনের রাসায়নিক পদার্থ) ও রিওয়ার্ড সেন্টার (আনন্দ অনুভব করার জায়গা) ক্রমাগত মাদক গ্রহণ করার জন্য শরীরকে বার্তা পাঠায় এবং একপর্যায়ে ব্যক্তিটি পুরোপুরি মাদকনির্ভর হয়ে পড়ে। এ সময় তার পড়ালেখার মান নষ্ট হয়, কর্মক্ষেত্রে কাজের মান নিচে নেমে যায়, সামাজিকভাবে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে আর পরিবারের মধ্যে এক অচেনা সদস্য হয়ে যায়। বাবা-মা বা পরিবারের নিকটজন কিন্তু তার আচরণে অনেকখানিই আন্দাজ করতে পারেন, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসকের কাছে তো নেনই না, এমনকি স্বজনদের কাছ থেকেও তার সেই মাদকাসক্ত সন্তানকে লুকিয়ে রাখেন; তার মাদকাসক্তির বিষয়টি নানাভাবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও এ ধরনের ছাত্রকে পারলে বহিষ্কার করে দেয় আর চাকরিজীবী হলে তার চাকরিটা যায় অথবা সবচেয়ে গুরুত্বহীন দপ্তরে তাকে বদলি করা হয়। বিবাহিত হলে অনেক সময় সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়। মাদক গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজন অর্থের। অর্থের জোগান যখন স্বাভাবিক পথে না আসে তখন চুরি, ছিনতাই ইত্যাদি নানা ছোট-বড় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। এরপর শুরু হয় সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়। মাদকের কারণে শরীরের নানা অঙ্গ (লিভার, কিডনি, হার্ট) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাদকজনিত মানসিক সমস্যা তৈরি হয়, এমনকি হেপাটাইটিস বি, সি ও এইচআইভি সংক্রমণেরও শিকার হতে পারে সে। চুরি-ছিনতাই যারা করতে পারে না, তারা অর্থের জোগান পেতে নিজেই জড়িয়ে পড়ে মাদক কেনাবেচার ব্যবসায়। এর মধ্যে কোনোভাবে মাদকাসক্ত ব্যক্তিটিকে সঠিক নিয়মে চিকিৎসা করানো হলে এবং তাতে সে সুস্থ হয়ে উঠলেও তার প্রতি আশপাশের মানুষজন সহজ চোখে তাকায় না, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, তাকে এড়িয়ে চলে। এসব কারণসহ আরও নানা কারণে সে আবার আসক্ত হয়ে যেতে পারে।
একদিকে যেমন মাদকের ব্যবহার ও ব্যাপ্তি বেড়ে চলেছে, আরেক দিকে তেমনি মাদকবিরোধী সচেতনতাও থেমে নেই। মিডিয়ায় চলছে মাদকবিরোধী প্রচারণা, পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে এ বিষয়ে প্রতিবেদন। চিকিৎসকেরা এগিয়ে আসছেন, বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোও পিছিয়ে নেই—টক শো হচ্ছে শিডিউল মেনেই। কিন্তু মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে না খুব বেশি। কেবল এ কারণে মাদকাসক্তি নিরাময়ে বেগ পেতে হচ্ছে অনেক।
প্রথম দিকে অভিভাবকেরা সন্তানের মাদকাসক্তির বিষয়টি গোপন করেন। কখনো বা মাদকাসক্তি নিরাময়ে সন্তানকে বিয়ে দিয়ে দেন। দুটি পদক্ষেপই তার সন্তানের জন্য মারাত্মক। মনে রাখা দরকার, মাদকাসক্তির যথাযথ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে। তাই দেরি না করে সন্তানকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হবে এবং বিষয়টি নিয়ে সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে স্বজন-বন্ধুদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। মাদকাসক্তি কোনো অপরাধ নয়, কোনো লজ্জার বিষয় নয়, এটি একটি রোগ। সন্তানের অন্য রোগ হলে তার বাবা-মা যতটা আকুল হয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যান, ততোধিক আকুল হয়ে মাদকাসক্তির চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। মাদকাসক্তির যে পর্যায়ে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন, সে সময় তার দেহে ও মনে বিপর্যয় ঘটে গেছে অনেক। হয়তো ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে অথবা শুরু করেছে মাদকের কেনাবেচার ব্যবসা। এই সময়ের আগেই যদি তাদের চিকিৎসা করানো হয়, তবে বিপর্যয় অনেকখানিই এড়ানো সম্ভব। আবার অনেক সময় মনে করা হয় যে বিদেশে পাঠিয়ে দিলে তার মাদকাসক্তি দূর হবে। কিন্তু এটিও একটি ভুল ধারণা। পৃথিবীর সব দেশেই মাদক তার ভয়াল থাবা বিস্তার করে চলেছে। এমনকি প্রায় সবখানে আমাদের দেশের চেয়ে বেশি। আর মাদক গ্রহণের সঙ্গীর অভাব হয় না। মাদকাসক্তি নিরাময়ে বিয়ে দেওয়ার ফল হয় আরও খারাপ—দাম্পত্য কলহ, মানসিক রোগসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়।
অনেক সময় দেখা যায়, বাবা হয়তো চিকিৎসকের কাছে তার সন্তানকে নিয়ে এসেছেন, কিন্তু মা বারবার সন্তানের মাদকাসক্তির কথা অস্বীকার করে যাচ্ছেন নানাভাবে বিভ্রান্ত করছেন চিকিৎসককে। চিকিৎসা যদিও বা শুরু হয়, অভিভাবকেরা অস্থির হয়ে দিন কয়েকের মধ্যে চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চিকিৎসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। পূর্ণমেয়াদে চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। কখনো বা প্রকৃত চিকিৎসার বদলে বাণিজ্যিক প্রচারণা ও প্রতারণার ফাঁদে পড়েন অভিভাবকেরা। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা যা করতে পারেন তা হচ্ছে, মাদকাসক্তির বিষয়ে তাঁদের মনোভাব পাল্টাতে পারেন। তাঁদের মনে করতে হবে যে এটা কোনো গোপন করার মতো বা লজ্জার বিষয় নয়। লজ্জা করলে বিষয়টি আরও জটিল হবে, যাতে সন্তানের জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাদকাসক্ত সন্তানকে রোগী হিসেবে মেনে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, প্রয়োজনে স্বজন ও নিকটজনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে সাহায্য চাইতে হবে। কারও যদি সন্দেহ হয়, তার নিকটজন মাদকাসক্ত, তবে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি তার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। সন্তানের প্রতি অযথা রাগ করা চলবে না। মাদকাসক্ত বলে তাকে দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না, বাসা থেকে বের করে দেওয়া যাবে না, বরং তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে লুকিয়ে বিদেশে পাঠানো চলবে না, মাদকমুক্ত না করে বিয়ে দেওয়া যাবে না। চিকিৎসার বিষয়ে ভালোমতো খোঁজখবর নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। যদি তা দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে ধৈর্য ধরতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তি চিকিৎসার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। কোনো ধাপ বাদ দিয়ে গেলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ফলে পুনরায় মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ সমাজের সবার এবং মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সুনাম রক্ষার্থে সিদ্ধান্ত নেয় যে সেখানকার কোনো শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তাকে বহিষ্কার করা হবে, কিন্তু এতে করে তার জীবনটা ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়। মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার না করে বরং বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে চিকিৎসা-সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। সামাজিকভাবে কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে হেয় না করে, তার পরিবারের প্রতি ঘৃণা-তাচ্ছিল্য না দেখিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
মাদকাসক্তি চিকিৎসার ধাপগুলো বেশ দীর্ঘমেয়াদি। তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করাতে হয়। অপরিপূর্ণ চিকিৎসার কারণে পুনরায় আসক্ত (রিল্যাপ্স) হতে পারে। মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তি ক্যানসার বা এইডসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করাতে হবে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত দপ্তর (ইউএনওডিসি) ১৯৮৭ সাল থেকে ২৬ জুন দিনটিকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ইউএনওডিসি এ বছর যে বিষয়টির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে তা হলো, ‘মাদকাসক্তি ও অপরাধ উন্নয়নের জন্য হুমকি’। ইস্যুটি নিয়ে ২৬ জুন জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত হবে থিমেটিক ডিবেট। পৃথিবীর সর্বত্র মাদক তার ভয়াবহ থাবা বিস্তার করে সমাজকে তলিয়ে দিচ্ছে অন্ধকারের দিকে। কলম্বিয়ার মতো রাষ্ট্রে মাদকসন্ত্রাসীরা এতটাই শক্তিশালী যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, আমাদের দেশেও আমরা দেখি মাদক ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আক্রমণ করছে, কখনো হত্যা করে ফেলছে প্রতিবাদকারীকে। এই মাদক চক্রের বিরুদ্ধে সবদিক থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদকের পেছনে সরাসরি হাজার হাজার কোটি টাকা বছরে খরচ হচ্ছে, পাশাপাশি মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে আরও অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির কারণে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে, আবার তাদের চিকিৎসায় পরিবারের টাকা খরচ হচ্ছে এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এ কারণেই মাদকাসক্তি ও অপরাধকে উন্নয়নের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, নানা অন্তরায় পাড়ি দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। তাই অগ্রসরমান বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে হলে মাদক নামের দানবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং তা এখনই।
আহমেদ হেলাল
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৭, ২০১২
alamgir
sir,amar hothat kore gola betha tapor jor o kuboi sordi,ke table khele valo hobo janaben. amar bois 25.
Bangla Health
আপনার এখানে সাধারণত ঔষধ দেয়া থেকে বিরত থাকি। আপনি একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন।
রাজু
ভালো হয়েছে।