ওষুধের অপব্যবহার ও মাদকের অবৈধ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চলছেই, চলবে। জাতিসংঘ ২৬ জুন দিনটি পালন করে একে ঘিরেই। নেশার ওষুধ মাদক সমাজে যে বড় সমস্যার সৃষ্টি করছে, এ বিষয়টি সবাইকে অবহিত করা হলো প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এই দিবস পালন করে নানা সমাজগোষ্ঠী ও সংস্থা, পৃথিবীজুড়ে। মাদক ও অপরাধ বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ অফিস হলো ইউএনওডিসি। বছরের পর বছর ধরে অবৈধ ওষুধ ও মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়তা প্রার্থনা করে নানা সংস্থার কাছে এবং অনেক সংস্থার সঙ্গে দলবদ্ধভাবে লড়াইও করে এর বিরুদ্ধে।
ইউএনওডিসির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০ কোটি মানুষ মাদক, নেশার দ্রব্য ব্যবহার করছে। যেমন, কোকেন, গাঁজা, হেলুসিনোজেন, আফিম ও ঘুমের ওষুধ পৃথিবীজুড়ে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত হলো, ওষুধের অপব্যবহার ও মাদকের অবৈধ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ২৬ জুন পালন করা হবে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে। মাদকের এমন ব্যবহারের বিরুদ্ধে যেন গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক জনমত, সৃষ্টি হয় পৃথিবীজুড়ে নানা দেশে মাদকবিরোধী সংস্থা। এ সিদ্ধান্ত পরবর্তী বছর ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আরও জোরালো সিদ্ধান্তে রূপ নিল। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ জনসমক্ষে দিবসটি পালনের ঘোষণা দিল।
মাদকের অবৈধ বাণিজ্য একসময় কেবল একটি সামাজিক সমস্যা ও অপরাধ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত ছিল, কিন্তু বর্তমান বছরগুলোয় এটি মানুষের জন্য ও ভৌগোলিক সীমারেখার জন্য স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা হুমকিতে রূপান্তরিত। আফগানিস্তানের আফিম ঘিরে শত শত কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য থেকে অর্থের জোগান হচ্ছে বিশ্বজুড়ে নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থানের জন্য, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস লালনে, এমনকি পশ্চিম আফ্রিকাকে অস্থিতিশীল করার জন্যও। ৮৫ বিলিয়ন ডলারের জগৎজোড়া, কোকেন বাণিজ্য উসকে দিচ্ছে মাদকাসক্তি, মানি লন্ডারিং; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকিও হয়ে উঠেছে। পশ্চিম আফ্রিকার মধ্য দিয়ে প্রতি এক বিলিয়ন ডলার কোকেন বাণিজ্য অবৈধ উপার্জন করেছে ১০ গুণ অর্থ ইউরোপের পথেঘাটে।
তাই মাদকের অবৈধ বাণিজ্য স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য একটি জরুরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো দেশই এর করাল থাবা থেকে উদ্ধার পাবে বলে মনে হয় না। এ বছরের ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ দিবস পালনের মধ্যে একটি তাৎপর্য নিহিত, তাই আইনের বিধান ও প্রয়োগ এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যা—এই দুটোর মাধ্যমে এই জোড়া হুমকিকে মোকাবিলা করার গুরুত্ব বিশ্ববাসীর কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বছরের এই দিবস পালনটি ১৯৬১ সালের সিঙ্গেল কনভেনশন অন নারকোটিক ড্রাগসের ৫০তম বার্ষিকী পালনের সঙ্গে মিলে গেছে। মাদকের বিরুদ্ধে এই সম্মেলন এবং অন্যান্য মাদকবিরোধী ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নানা আন্তর্জাতিক চুক্তিও সংস্থাগুলো মাদকের অবৈধ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তুলবে, যেসব জনগোষ্ঠী মাদক ও নেশাদ্রব্য গ্রহণের প্রতি প্রবণ, তেমন ভঙ্গুর মানুষের জন্য সুরক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে নানা কাজকর্ম, দেশে দেশে সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিরোধ ও শিক্ষা দুটো ব্যাপারেই উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা, ওষুধের ওপর নির্ভরতার চিকিৎসা, মাদকসেবীদের জন্য পরিচর্যা ও পুনর্বাসন এবং সে সঙ্গে সামাজিক অবলম্বন।
এসব ব্যবস্থা নেওয়া বড়ই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওষুধের ব্যবহার, মাদকেরও ব্যবহার—এ সবকিছুর মূলে হলো হেলথ ইস্যু। ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা হলো একটি অসুখ, প্রকৃত অর্থে অপরাধ নয়। সত্যিকারের অপরাধী হলো মাদক ব্যবসায়ীরা।
তবে মাদকের সরবরাহের দিকটি হলো সমীকরণের অর্ধেক মাত্র; অবৈধ ওষুধের চাহিদা যদি হ্রাস না করা যায়, তাহলে আমরা কখনোই মাদকের চাষ, উৎপাদন ও অবৈধ বাণিজ্য রোধ করতে পারব না। মাদকের অবৈধ বাণিজ্য ও অপব্যবহার এই দুটোকেই প্রতিহত করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তবে লোকসমাজ, জনগোষ্ঠীও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, সুশীল সমাজ, ধর্মীয় সংগঠন এরাও জনসমাজকে মাদকের কবলমুক্ত করতে উদ্যোগ নিতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠন আইনসংগত জীবনধারণের উপায় পেতে সাহায্য করতে পারে বেকারদের। মাদকগ্রহণের ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে গণমাধ্যম জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারের মৌলিকনীতি, অংশীদারির দায়িত্ব, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাসের জন্য উদ্যোগ, চিকিৎসা ও সাপোর্ট—এসব বিষয়ের প্রতি সুসম দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়বদ্ধতা থাকলে এ লড়াইয়ে জেতা সম্ভব। জনগোষ্ঠী মাদক সম্পর্কিত অপরাধ ও আগ্রাসন থেকে মুক্ত হবে, মাদকের প্রতি নির্ভরশীলতা কমবে, নিরাপদ হবে পৃথিবী।
২৬ জুন মাদক অপব্যবহার ও অবৈধ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস, যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সম্মেলনে। মাদক অপব্যবহারমুক্ত পৃথিবী চাই। বিশ্বব্যাপী এই অভিযানের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘স্বাস্থ্য’। এই অভিযান সফল হোক। এই সমাজ, এই পৃথিবী একদিন হবে মাদকমুক্ত। সেই প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৭, ২০১২
Leave a Reply