রাত বয়ে যায়, আসে না তো ঘুম…
শুয়েছেন, কিন্তু ঘুম হবে কী করে? পা দুটো চঞ্চল। নিজের ইচ্ছাতেই অস্থির হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ক্লান্ত-শ্রান্ত শুয়ে পড়েছেন শয্যায়। চোখে ঘুম এলো বলে, কিন্তু হঠাৎ করে পা দুটোতে অদ্ভুত একটি অনুভূতি। পায়ের পেশিগুলোতে চুলকানি ভাব, ছমছমে অনুভূতি, কী যেন গুটি গুটি করে এগোচ্ছে পায়ের পেশি বরাবর… হামাগুড়ি দিয়ে চলছে কিছু পা দিয়ে… শিহরণ জাগছে মাঝে মাঝে…। আর যত শক্ত করে পা দুটো স্থির করতে চেষ্টা করা হলো, তত জোরালো করে সেই অনুভূতিগুলো ফিরে আসছে পায়ে।
দুর্ভাগ্যবশত কিছু লোকের মধ্যে এটি দেখা যায়, তাদের ওপর এ নির্যাতনটি চলে, এই দুর্বিপাক রোগটির নাম হলো জবংষবংং ষবম ংুহফৎড়সব (জখঝ). একে আমরা ‘আরএলএস’ বলবো। আক্ষরিক বা প্রতিশব্দ এর নাই বা করলাম।
আরএলএস একটি স্নায়ুবিক রোগ, যে রোগে পা দুটো প্রচণ্ড অস্থির হয়ে ওঠে, পা দুটো নড়ানোর জন্য প্রবল, অদম্য ইচ্ছা মনে জেগে ওঠে। এ রোগের কথা তেমন প্রচারিত নয়। রোগীরা যখন অভিযোগ করেন সাধারণ চিকিৎসাজীবীরা অনেকে এর জন্য পরামর্শ দিতে পারেন না। তাই আরএলএস’র রোগীরা অনাবশ্যক যন্ত্রণার শিকার হন, তবে এ রোগের চিকিৎসাও আছে।
‘টুইচিং লেগস’ আরএলএস স্ত্রী-পুরম্নষ উভয়ের মধ্যে সমানভাবেই ঘটতে পারে। বয়স বাড়লে এর আশঙ্কা ও ঝুঁকি বাড়ে। বিপর্যয়ের অনুভূতি অনেক সময় কেবল দুটো পা নয়, বাহুকেও আচ্ছন্ন করতে পারে। সন্ধ্যাবেলায় বা রাতে শোয়ার সময় এর আবির্ভাব ঘটে। তবে দিনের বেলায়ও হঠাৎ এর আক্রমণ ঘটতে পারে। বিশ্রাম নেয়ার সময় এর আবির্ভাবের আশঙ্কা বেশি। ঘুরে বেড়ালে বা হাঁটলে এ অস্বস্তি কমে, আবার বসে থাকলে বা শুয়ে থাকলে এই আক্রমণ ফের শুরম্ন হয়ে যায়।
অনেকে নিজেরা বা তাদের শয্যাসঙ্গীরা অভিযোগ করেন রাতে হঠাৎ করে অনিচ্ছাপ্রসূত পা দুটো প্রবল নড়াচড়া শুরম্ন হয়ে যায়। কারো হয় মাঝে মাঝে, কারো হয় প্রতি রাতে। বাল্টিমোরে জনহপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক ডক্টর রিচার্ড এলেন বলেন, উপসর্গগুলো আগে অনুভূত হলে যেমন চলি্নশ বছর হওয়ার আগে, তখন এগুলো মৃদু প্রকৃতির হয় আর বয়স যত বাড়তে থাকে, অবস্থা তত শোচনীয় হতে থাকে।
জীবনের পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশ বছর ঊর্ধ্বে হলে, উপসর্গ শুরম্নতেই প্রচণ্ড হয়ে থাকে।
কী জন্য হয় আরএলএস?
আরএলএস কেন হয় তা জানা যায়নি। তবে বংশগত, রক্তশূন্যতা, স্নায়ুর রোগ, কিডনি বিকল ও ডায়াবেটিস এ রোগের সঙ্গী হতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা একটি কথা বলছেন যে, আরএলএস মনোরোগ নয়। জনহপকিনস-এর গবেষক ড. রিচার্ড এলেন বলেন, çডব হড় িশহড় িপষবধৎষুঃযধঃ রঃ রং ধ নরড়ষড়মরপধষ ফরংড়ৎফবৎ.ÿ
এমন কিছু তথ্য আছে, মগজের রাসায়নিক ডোপামিন ঘাটতি, এ রোগে ভূমিকা রাখতে পারে। আর একটি তথ্য হলো, শরীর যে পদ্ধতিতে লোহাকে প্রক্রিয়াজাত করে সেই পদ্ধতিতে সমস্যা হলে আরএলএস’র সাথে সম্পর্কিত থাকতে পারে।
ডা.
এলেন বলেন, মনে হয় একধরনের লোহা ঘাটতি চলতে থাকে, মগজে এবং সুষুমা তরলে লোহার ঘাটতি হয় আরএলএস রোগীদের।
আরএলএস নিয়ে জীবনযাপন
চিকিৎসা না হলে এ রোগীরা অনিদ্রা রোগে ভোগেন, ক্রনিক হয়ে যায় পরবর্তী সময়ে। পরে শরীর হয় ক্লান্ত-শ্রান্ত স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, কাজকর্ম, পারিবারিক সম্পর্ক ও জীবনের গুণগত মানের ওপর বিপর্যয় ঘটে যায়। তেমন উপসর্গ হলে রোগী সিনেমা হলে ছবি দেখতে পারে না ইচ্ছা করলেও, দূরপাল্নার ভ্রমণে যেতে পারে না, কারণ এত দীর্ঘ সময় স্থির হয়ে থাকার উপায় নেই। পা নড়াচড়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর অব রিসার্চ অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কেরি মারি বলেন, রাতের পর রাত এরকম চলতে থাকে, নির্ঘুম রাত, পায়ে অস্থিরতা, অনাবশ্যক শিহরণ মনে হয় আর কোনো আশা নেই। ‘মানুষ ঘুরেফিরে বেড়াতে পারে না, ভ্রমণ করতে পারে না, দূরে থাকে এমন স্বজনের কাছে যেতে পারেন না, অনেক সময় কাজ ছেড়ে দেন, অবসর নিয়ে নেন।’
সুখবর হলো ঠিকমতো চিকিৎসা নিলে উপসর্গ বেশ আরাম হয়। পা দুটোর মধ্যে যদি চুলকানি, চুলবুল করা অনুভূতি, পায়ের চামড়ার নিচে কী যেন হামাগুড়ি দিয়ে চলছে, এমন হলে ডাক্তার দেখানো ভালো। আরএলএস সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ এমন ডাক্তার দেশেও আছেন।
দু’পায়ের ভেতরে পিঁপড়ার দল যেন সারি সারি চলছে। কী যেন একটা কিছু পায়ে চামড়ার নিচে, আরো গভীরে হামাগুড়ি দিয়ে চলছে, ঝিনঝিন অনুভূতি, খিঁচুনি ভাব, শিহরণ, আরএলএস’র এমন সব উপসর্গ। স্নায়বিক বৈকল্য। পা দুটো নড়াচড়ার জন্য মনে অদম্য ইচ্ছা জেগে ওঠে।
মাসে পাঁচবার বা এর বেশি যদি এমন হিসহিসে অনুভূতি হয়, তাহলে ডাক্তার দেখাবেন।
আরএলএস হলে সেই সাথে দেহে অন্য কোনো রোগ আছে কি না তা চেকআপ করে নেয়া ভালোঃ নির্দিষ্ট করে টেস্ট করে আরএলএস বোঝা যায় না। তবে রক্তশূন্যতা আছে কি না, কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস আছে কি না তা চেক করা যায়। এসব উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে থাকলে রোগের আরাম হয়। যেমন যদি সেরাম ফেরিটিন মান কমে যায় দেহের লোহার পরিমাণ কত তা জানা যায় (<৫০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার) লোহা সাপি্নমেন্ট নিলে আরএলএস যথেষ্ট আরাম হয়।
ঘুরে বেড়ানঃ স্থির হয়ে শুয়ে বসে থাকা এবং পা নড়ানোর জন্য মনের প্রবল ইচ্ছার বিরম্নদ্ধে লড়াই করে লাভ নেই। মৃদু উপসর্গে, কী করবেন? উঠে দাঁড়ান, ঘুরে বেড়ান বেশ আরাম হবে।
স্ট্রেচিং করম্ননঃ যে পেশিগুলো আক্রান্ত হচ্ছে সেই পেশিগুলো টানটান করলে, ম্যাসাজ করলে, আরএলএস আরাম হতে পারে। যেমন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা দুটো কাঁধ সমান ফাঁক করে দাঁড়ান। অদৃশ্য কোনো চেয়ারে যেন বসেছেন, হাঁটু ও কোমর তেমন ভান করে বসুন।
গোসল করম্নন উষ্ণ পানিতেঃ উষ্ণ পানিতে গোসল করলে বেশ আরাম হতে পারে।
ব্যায়াম করম্ননঃ নিয়মিত ব্যায়াম করলে স্বাস্থ্যের ওপর হিতকরী ফল তো আছেই আরএলএসও আরাম হয়। সপ্তাহে পাঁচ দিন ৩০-৪০ মিনিট মাঝারি মাপের ব্যায়াম করম্নন। হৃদপিণ্ডও সতেজ সবল হবে।
মদ ও কফি বর্জন করম্ননঃ মদ্য পান ও কফি পান বর্জন করম্নন। ধূমপান করবেন না।
ওষুধ খাবেন ভেবে চিন্তে কিছু কিছু ওষুধ যেমন এন্টিহিস্টামিন ওষুধ, ঠাণ্ডা সর্দির ওষুধ, বিষণ্নতাবোধী ওষুধ আরএলএস’র প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
নিদ্রাসূচি বদলাতে পারেঃ আরএলএস’র আক্রামণ ঘটে সাধারণত দিন বা রাতের নির্দিষ্ট সময়ে। তাই নিদ্রাসূচি এমন সময়ে করতে পারেন যখন এ রোগের উপসর্গের আবির্ভাব সাধারণত ঘটে না।
ডাক্তারের পরামর্শঃ ওষুধ দিতে পারেন ডাক্তার আরামের জন্য। তবে সম্পূর্ণ নিরাময় হবে ভাবা ঠিক নয়। আরাম হবে মাত্র। তাই ডাক্তারের সাথে লেগে থাকুন।
—————–
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
ডাইরেক্টর, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৬ এপ্রিল ২০০৮
Leave a Reply