ছোটখাটো দুর্ঘটনা যেকোনো সময়ই ঘটতে পারে। প্রাথমিকভাবে সেসব সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি ঘরেই যেন থাকে।
দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কিছু না কিছু জরুরি বিষয় ঘটে। আম কাটতে গিয়ে হাতটা একটু কেটে গেল, রান্নার সময় একটু গরম পানি ছিটল, বেসিনে ঠান্ডা পানির পরিবর্তে গরম পানির কলে হাতটা একটু ঝলসাল, হঠাৎ নাক দিয়ে রক্তপাত—এমনটা হরহামেশাই ঘটে। নিত্যদিনের ঘরোয়া ইমার্জেন্সিগুলো আমরা নিজেরাই সামাল দিতে পারি। প্রয়োজন একটু সচেতনতা আর কিছু জরুরি সরঞ্জাম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দরকার ফার্স্ট এইড আর সঙ্গে একটি ফার্স্ট এইডের থলি।
হঠাৎ কেটে গেলে
এখন তো ফলের মৌসুম। ফল কাটতে গিয়ে হঠাৎ ছুরির কোনায় লেগে কেটে গেল হাত—অল্পই হয়তো। রক্ত ঝরছে। ব্যথা। করবেন কী? যেকোনো কাটার ক্ষেত্রেই প্রথম কথা হলো রক্তপাত বন্ধ করতে হবে দ্রুত। কাজেই যেখান থেকে রক্ত ঝরছে, সেখানটায় চেপে ধরতে হবে, যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় নিয়মেই দু-এক মিনিটের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। তাই অল্প কিছুক্ষণ রক্তক্ষরণের জায়গাটি চেপে ধরে রাখলে রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে। ক্ষত যদি গভীর না হয়, তাহলে রক্তপাত বন্ধ হলে একটু তুলা দিয়ে মুছে যেকোনো অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিলেই হলো। যদি ক্ষত বেশি হয় এবং সেলাইয়ের প্রয়োজন হয়, তবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে পরিষ্কার কাপড় বা ফার্স্ট এইড বক্সে রাখা ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থানটি পেঁচিয়ে হালকাভাবে বেঁধে রাখতে হবে। আর যদি কেটে না গিয়ে স্থানে স্থানে চামড়া ছিলে যায়, তাহলে ছিলে যাওয়া বা ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাগুলোতে আয়োডিন ক্রিম লাগিয়ে দিলেই চলবে।
হঠাৎ নাক দিয়ে রক্ত ঝরলে
মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে পারে। গরমেও এটা হতে পারে। এতে ভয় না পেয়ে একটু প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে হবে আর নাকের ওপরের শক্ত অংশ বরাবর আঙুলের চাপ দিয়ে নাক ধরে রাখতে হবে পাঁচ মিনিট। এতে স্বাভাবিকভাবে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যাবে। যদি আঙুল ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়ার পরও রক্ত ঝরে, তবে আরেকটু বেশি সময় চেপে ধরতে হবে এবং প্রয়োজনে বরফ অথবা ঠান্ডা রুমাল ব্যবহার করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো সমস্যা না হয়। রক্ত ঝরা বন্ধ হলে অন্তত ঘণ্টা খানেক নাক ঝাড়া যাবে না। এতে করে আবারও রক্তপাত শুরু হতে পারে।
হঠাৎ পুড়ে গেলে
গরম পানিতে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে—রান্নার সময়, চা খাওয়ার সময় কিংবা অনেক সময় গোসলে গরম পানি ব্যবহার করতে গিয়ে। কখনো ইলেকট্রিক শক থেকেও হতে পারে। পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে প্রথম কাজ হলো, প্রচুর ঠান্ডা পানি ঢালা—ত্বকে ক্ষতের ওপর—রানিং ওয়াটার। সচল পানি। পোড়া জায়গায় কলের পানি ঢালা অথবা কোনো পাত্র থেকে পানি ঢেলে ক্ষতস্থানটিকে ঠান্ডা করাই প্রাথমিক চিকিৎসা। এরপর অ্যান্টি-বার্ন ক্রিম মাখানো। যদি ক্ষত বেশি হয়, ফোসকা পড়ে যায়, তবে যথাশিগগির চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
ছোট বাচ্চা খেলতে গিয়ে ব্যথা পেলে
অনেক সময় ছোট বাচ্চারা তাদের স্বভাবজাত দুরন্তপনার জন্য বিভিন্ন ধরনের আঘাত পায়। পড়ে গিয়ে হাত-পা ফুলে যাওয়া কিংবা ছোটখাটো কাটাছেঁড়া তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। কেটে গেলে, ছিলে গেলে—তুলা বা ব্যান্ডেজ দিয়ে পরিষ্কার করে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগাবেন, ঠিক হয়ে যাবে। একটু ভিটামিন সি খেতে দেবেন। ঘা শুকিয়ে যাবে দ্রুত। যদি পড়ে গিয়ে হাত বা পা ফুলে যায়, তবে ঠান্ডা বরফ দিতে পারেন। কখনোই মালিশ বা গরম শেক দেওয়া ঠিক নয়। হাত বা গায়ের ফোলা বেশি হলে, ব্যথা বেশি হলে এবং যে জায়গা ফুলে গেছে, তা স্পর্শে বেশি গরম মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ক্রনিক রোগীদের মেডিকেল ইমার্জেন্সি
অনেকের বাড়িতেই বয়োজ্যেষ্ঠ ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত কিংবা হূদেরাগী আছেন, এঁদের আমরা ক্রনিক রোগী বলি। হাঁপানিও এই দলভুক্ত।
এ ধরনের ক্রনিক রোগীকে নিয়মিত কিছু ওষুধ সেবন করতে হয়। আবার জীবনাচারে কিছু ব্যত্যয় ঘটলেই বিপর্যয় নেমে আসে। তখন দেখা দেয় মেডিকেল ইমার্জেন্সি। ধরা যাক, ডায়াবেটিসের রোগী সময়মতো খেলেন না কিংবা ইনসুলিনের ডোজে তারতম্যের করণে ‘হাইপো’ হলো বা রক্তের সুগার কমে গেল—তখন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মিষ্টিজাতীয় কিছু খাইয়ে তাঁর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক করতে হবে, নইলে বেশ ভালো বিপর্যয় হতে পারে।
রাতে ওষুধ খেতে মনে নেই, সকালে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গেছে—মেপে দেখলেন, তখনই ওষুধ খাইয়ে দিতে হবে।
হূদেরাগীদের ফার্স্ট এইড বক্সে সব সময় নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে থাকতে হবে।
হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে জিবের নিচে স্প্রে করতে হবে সঙ্গে সঙ্গে।
হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে
ভীষণ গরম। হিট স্ট্রোক না হোক, এমনিতেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে পারেন হঠাৎ করে। এমনটা হলে সঙ্গে সঙ্গে শুইয়ে দিন পা উঁচু করে। মুক্ত বাতাস দিন। শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক থাকলে একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে। তখন অল্প পরিমাণে পানি পান করান।
সিপিআর শিখুন
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রি-হসপিটাল ইমার্জেন্সি মোকাবিলার জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বেসিক লাইফ সাপোর্টের। ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর। পানিতে ডোবা কিংবা আগুন লাগার কারণে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষকে বাঁচানোর উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে সিপিআর। সময় এবং সুযোগ পেলে সিপিআরের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখা ভালো এবং জরুরি। ইন্টারনেটেও নিতে পারেন। আজকাল ঢাকাতেও সিপিআর প্রশিক্ষণ হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে।
তৈরি করুন ফার্স্ট এইড ব্যাগ
নিজের প্রয়োজনের সময় প্রাথমিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্য সরঞ্জাম নিয়ে একটি ফার্স্ট এইড ব্যাগ তৈরি করুন। জরুরি চিকিৎসায় এটি খুবই প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। পাশের ছকে দেখুন ফার্স্ট এইড বক্স তৈরির সরঞ্জামের তালিকা।
কোথায় রাখবেন
ফার্স্ট এইড বক্স তৈরি করে বিভিন্ন জায়গায় রাখা যেতে পারে। বাড়িতে, গাড়িতে, অফিসে আলাদাভাবে। বাড়িতে সিঁড়িকোঠায় না রেখে হাতের কাছে রাখতে হবে, যাতে প্রয়োজনের সময় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। প্রতি মাসে একবার আপনার ফার্স্ট এইড ব্যাগটি পরীক্ষা করুন— আপডেট করুন। তিন থেকে ছয় মাস পর পর পুরোনো জিনিসগুলো বদলে নিন। যেকোনো জরুরি অবস্থায় প্রথম ৩০ মিনিট বা প্রথম আধা ঘণ্টা হলো ‘প্লাটিনাম পিরিয়ড’ আর প্রথম ঘণ্টাটি হলো ‘গোল্ডেন পিরিয়ড’।
কাজেই জরুরি অবস্থায় যত দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন, ক্ষতির পরিমাণ ততই কমবে। এটাই ফার্স্ট এইডের মাজেজা।
ইকবাল কবীর
সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম
Leave a Reply