অপেক্ষার কাল যেন শেষ হতে চায় না।
অপেক্ষার সঙ্গে যেন যুগলবন্দী এই ক্যানসার রোগটি।
চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা, টেস্টের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা, অ্যাপয়েনমেন্টের জন্য অপেক্ষা, বিশেষ করে ভালো দিনের জন্য অপেক্ষা…
সুলেখা নামেই ডাকি তাকে। এই তো সেদিন ধরা পড়ল তার ব্লাড ক্যানসার লিউকেমিয়া। অপেক্ষা বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য। ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসাপদ্ধতি। তবু উপায় নেই, সেরে ওঠার একমাত্র উপায় তাঁর এ ধরনের ক্যানসারের।
অনেক কথা মনে পড়ছে সুলেখার। একুশ-উত্তর বয়সে তার বন্ধুরা স্বপ্নের জাল বুনতে ব্যস্ত। জীবনে ফাগুনের রং। হাতে মেহেদির ছাপ। হেসে খলখল, গেয়ে কলকল জীবন।
নতুন জীবন শুরু করাতে ওরা ব্যস্ত। ২৩ বছর বয়সে সুলেখা ভাবছে, এই বুঝি জীবনদীপ নিভে যাবে… শুরু হওয়ার আগেই।
সুলেখার পরিবার আমেরিকায়। সম্পদশালী মা-বাবার ঘরে তার জন্ম। তাই সে চিকিৎসার কথা ভাবছে। ভাবছে ভালো হওয়ার কথা। তা না হলে এমনি মরতে হতো। এই বড় ভাগ্য তার।
রোগটি তার যখন ধরা পড়ল, অনেক ঝুঁকিপূর্ণ তখন তার রোগ, বেশি অগ্রসর হয়ে গেছে রোগটি। শয্যাশায়ী সুলেখা: মুখে ঘা, ক্ষত, কথা বলতে ভয়ানক কষ্ট, খেতেও বড় কষ্ট। এদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি অনেক কমে এসেছে। তাই ছোটখাটো জীবাণু সংক্রমণও বড় বিপর্যস্ত করে তাকে।
রোগ ধরা পড়ার পর থেকেই তার জীবনটা যেন একটি জরুরি চিকিৎসাঘরে আটকে গেল। আর পৃথিবীটা যেন হয়ে পড়ে অপেক্ষাঘর। প্রতি মাসে এক রাউন্ড কেমো, এরপর চিকিৎসকেরা আবার ম্যারো পরীক্ষা করে দেখেন ট্রান্সপ্ল্যান্টের উপযুক্ত হলো কি না।
‘এখনো হয়নি’ এমন কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত যেন সুলেখা।
আরও দু-এক রাউন্ড।
জীবনসংশয়ী রোগ নিয়ে বেঁচে থাকা মানে যেন সময়ের দেশে ম্রিয়মাণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা। কেমন যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। রোগ কেবল শরীরকেই সংক্রমিত করে না, নিজের অতীতে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপরও প্রভাব ফেলে।
অতীত নিয়ে ভাবতে বসলে নস্টালজিয়া নাড়া দেয় প্রবলভাবে: কিন্তু তা হতো প্রথম প্রথম; সুলেখার কাছে সত্যি তা বিস্মৃত অতীত হয়ে গেছে এখন…। টানটান সরু সুতোর মতো জীবন, কখন কী হবে ঠিক নেই। ভবিষ্যতের দিবাস্বপ্ন কেন? তারুণ্যের উদ্দীপ্ত জীবনকে ভেবে ভেবে মন খারাপ করা কেন?
বর্তমান সময়ও বড় অনিশ্চিত। সামনের মাসে চিকিৎসকেরা ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য একটি তারিখ দিলেন। সুলেখা অবাক। কিন্তু কিছুদিন পর আবার তাঁরা সে তারিখ বদলালেন। নতুন তারিখ দেওয়া হলো। এ সপ্তাহ থেকে ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রস্তুতি শুরু।
ট্রান্সপ্ল্যান্ট-প্রক্রিয়া শুরুর দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। একে ‘জিরো দিবস’ও বলেন সার্জনরা। প্রবল মাত্রায় কেমোথেরাপি দিয়ে দেহের ইমুন সিস্টেমকে পুরোপুরি দাবিয়ে দেওয়া। আর পরিবর্তে সুস্থ স্টেম কোষগুলোর স্থাপনা শরীরে বসানো।
সুলেখা ভাগ্যবতী বটে; তার নিজের ভাইয়ের বোনম্যারো বেশ মিলে গেল তার সঙ্গে। চমৎকার ম্যাচিং। হাড়ের মজ্জা ম্যাচ না করলে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে কীভাবে?
ভাইটি হবে দাতা। সুলেখা হবে গ্রহীতা। ক্যানসার রোগীদের জন্য বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট যেন নবজন্ম, দ্বিতীয় জন্মদিন। তবে যদি তা কাজ করে, তা হলেই। বিকল্প কী? ভাবতে চায় না সুলেখা।
ট্রান্সপ্ল্যান্টের দিন এগিয়ে আসতে থাকে; ট্রান্সপ্ল্যান্ট হওয়ার আগের সপ্তাহ যেন প্রতীক্ষার অসহ্য প্রহর; কাউন্টডাউনের সাগ্রহ অপেক্ষা। কী করে অপেক্ষার দিনগুলো আরও ভালোভাবে কাটানো যায়, সে নিয়ে ভাবে সুলেখা। মনকে ভাবনার জাল থেকে বের করা কঠিন, তাই মনকে সরানোর চেষ্টা তার চিন্তা থেকে… ভাবনা যেন আর শেষ হতে চায় না।
প্রতিটি মুহূর্তকে যত অর্থপূর্ণ করে তোলে সুলেখা, তত যেন অতি সচেতন মনে হয় নিজেকে; খুব চাপগ্রস্ত মনে হয়।
মুহূর্তগুলোকে বরং উপভোগ করা ভালো। ভাবনা আর নয়। বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার করার পরিকল্পনার ছকও যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ডিনার স্মরণীয় করে রাখা যাবে কেমন করে? আলাপ-আলোচনাও যেন হয় বড় সুন্দর, মন ভরানো। তার মন দৌড়াতে থাকে, চলতে থাকে…।
ক্যানসার তাকে এ রকম অভিঘাত দিল; সন্ত্রস্ত করল, জাগরণ তুলল শরীর-মনে, আগে এর অস্তিত্ব ছিল কি? রোমান কবি Horace বলেন, `Corpe Diemx আমরা কথা বলছি, ইতিমধ্যে হিংসুক সময় পেরিয়ে গেছে… গল্প শেষ হয়নি…।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৩, ২০১২
Leave a Reply