চিকিৎসার আগে রোগের পর্যায় নির্ণয় জরুরি
ছেলেটির বয়স মাত্র নয় বছর। গত মাসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ভর্তি হয়েছে প্রচণ্ড পেটব্যথা নিয়ে। দুই দিন হলো পায়খানা হচ্ছে না। একদিন প্রস্রাব আটকে যায় সকাল থেকে। কিছু খেলেই পেটব্যথা করে তাই কিছু খেতে পারছে না। পেট ফুলে গেছে। গায়ে জ্বর, সঙ্গে সারা শরীর ব্যথা। তার মায়ের কাছ থেকে জানা গেল, গত বছর ডিসেম্বরে এ রকম ব্যথা হওয়ায় ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
ব্যথা ছিল শুধু তলপেটের ডান দিকে। তখন পেটের সেই স্থানে চাকা অনুভূত হয়েছিল। আলট্রাসনোগ্রাফিতে চাকাটি অ্যাপেনডিক্সজনিত বলায় তখন চিকিৎসকেরা অপারেশন করেননি। শুধু ওষুধে ভালো হয়ে যাওয়ায় ছয় সপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু পয়সা না থাকায় ছয় সপ্তাহ পর চিকিৎসকের কাছে আনা যায়নি।
এখন পুরো পেট ফুলে ব্যথা হওয়ায় হাসপাতালে আনতে হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল, অনুভূত চাকাটি আকারে অনেক বড় হয়ে গেছে। পেটের আরেকটি স্থানেও চাকা দেখা দিয়েছে। বাহুমূল ও গলার কয়েকটি লসিকাগ্রন্থি ফুলে গেছে, যদিও তাতে ব্যথা নেই। সূক্ষ্ম সুইয়ের সাহায্যে অনুভূত চাকা থেকে কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে জানা গেল, ছেলেটি রক্তের শ্বেতকণিকার ক্যান্সারে আক্রান্ত। রোগের নাম নন-হজকিনস লিম্ফোমা।
ফুলে ওঠা চাকা অন্ত্রনালিতে চাপ দেওয়ায় কিছু খেলেই পেটে ব্যথা হচ্ছে, পেট ফুলে যাচ্ছে। প্রস্রাব নিঃসরণের পথে চাকাটি বাধা দিচ্ছে বলে মাঝেমধ্যেই তার প্রস্রাবও আটকে যাচ্ছে।
আমাদের শরীরের শ্বেতকণিকা দেহকে নীরোগ রাখতে প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়। এই শ্বেতকণিকা আবার বিভিন্ন ধরনের। এর মধ্যে লিম্ফোসাইট নামে শ্বেতকণিকা থেকে লিম্ফোমা ক্যান্সার হয়। এর প্রধান দুটো শ্রেণীভেদ হচ্ছে হজকিনস ও নন-হজকিনস লিম্ফোমা। শরীরে যে লসিকা-রস আছে, তার কাজ হচ্ছে দেহকে রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। লসিকা-রস কাজ করে একটি সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, যা গঠিত লসিকাগ্রন্থি, প্লীহা, টনসিল, অস্থিমজ্জা ও দেহের নানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লসিকাকোষ নিয়ে। লসিকাগ্রন্থিগুলো বাহুমূল, গলা, তলপেট (কুঁচকি), কনুই ও পেটে ছড়িয়ে আছে। সাধারণ উপায়ে এগুলো খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রদাহ বা ক্যান্সারের কারণে এগুলো যখন আকারে বড় হয়ে যায়, তখন হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে এগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।
কারণ
এ রোগের নির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে কিছু ভাইরাস (যেমন এইচআইভি) ও ব্যাকটেরিয়াকে (স্ক্রুর মতো প্যাঁচানো পাকস্থলীতে থাকা হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি) এর জন্য দায়ী করা হয়। রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
উপসর্গ
হজকিনস লিম্ফোমার প্রধান উপসর্গ গলার লসিকাগ্রন্থি ফুলে ওঠা। এতে ব্যথা থাকে না।
তবে জ্বর, গা ব্যথা, দুর্বলতা, ওজন কমে যাওয়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যকৃৎ, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া প্রভৃতি উপসর্গ থাকতে পারে। নন-হজকিনস লিম্ফোমার ক্ষেত্রে শরীরের কয়েকটি স্থানে লসিকাগ্রন্থি একই সঙ্গে আক্রান্ত হয়, দ্রুত বড় হয়ে ওঠে এবং এগুলো নরম ও ব্যথামুক্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেটের ভেতরই প্রথম চাকা বাঁধতে দেখা যায়, যা উল্লিখিত ছেলেটির ক্ষেত্রে হয়েছে। কিডনি, মুখ, মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়, হাড়ে রোগ দ্রুত ছড়ায়। জ্বর, গা-ব্যথা, ওজন কম প্রভৃতি উপসর্গ থাকতে পারে; যকৃৎ, প্লীহা বড় হয়ে যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়
ফুলে ওঠা লসিকাগ্রন্থি বা পেটে অনুভূত চাকা থেকে কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাকেই সংক্ষেপে এফএনএসি বলা হয়। আলট্রাসনোগ্রাফি, বুকের এক্স-রে, সিটিস্ক্যান রোগ নির্ণয়ে এবং তা কতটুকু ছড়িয়ে পড়ে তা জানতে সাহায্য করে। সে অনুযায়ী চিকিৎসা-পদ্ধতি ঠিক করা হয়।
চিকিৎসা
চিকিৎসা শুরুর আগে রোগের পর্যায় নির্ণয় করা জরুরি। রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিয়ে এর চিকিৎসা করা হয়। সর্বাধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে ইমিউনোথেরাপি। অবশ্য এটি খুবই ব্যয়বহুল। কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনকে সিঙ্গাপুরে ইমিউনোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। শুরুতে রোগ ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়।
খুব কম ক্ষেত্রেই অপারেশনের প্রয়োজন হয়। এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি খুবই জরুরি।
—————–
প্রথম আলো, ৯ এপ্রিল ২০০৮
ডা. ইশরাত ফেরদৌসী
সার্জারি বিভাগ, বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা
Leave a Reply