আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে একদিন হঠাৎ গলার ডান দিকের ফোলা অংশটা নজরে আসে শিপ্রার মায়ের। হাত দিয়েও জিনিসটা অনুভব করতে পারলেন তিনি। চিন্তিত হয়ে শিপ্রাকে ডেকে দেখালে সেও দুশ্চিন্তায় পড়ল বিষয়টি নিয়ে। কী করবে, কার কাছে যাবে—সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অবশেষে একদিন বিকেলে মাকে নিয়ে সে গেল নাক-কান-গলার একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। চিকিৎসক তাঁকে গলার থাইরয়েড গ্রন্থির একটা আলট্রাসনোগ্রাম করতে দিলেন; সঙ্গে রক্তে থাইরয়েড হরমোনের কিছু পরীক্ষা। রিপোর্টগুলো নিয়ে পরদিন যাওয়ার পর নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ শিপ্রার মাকে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালেন। এত দিন মাথায় ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো তাঁর কাছেই প্রথম খুলে বলল শিপ্রা। থাইরয়েডের সমস্যার কথা আজকাল অনেকের কাছেই শোনা যায়। থাইরয়েড আসলে কী? শরীরে এটি কি কাজ করে? থাইরয়েডের সমস্যা মানেই কি ঘ্যাগ রোগ? থাইরয়েডে চাকা থেকে কি ক্যানসার হতে পারে? চাকা হলে বা ফুলে গেলে কি কেটে ফেলে দেওয়া জরুরি?
থাইরয়েড একটি অতিজরুরি গ্রন্থি: শিপ্রার মতো এমন সব প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের প্রায়ই হতে হয়। কেননা থাইরয়েড গ্রন্থির নানা সমস্যায় কেবল আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জীবনের বিভিন্ন সময় আক্রান্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপক সুযোগ ও সহজলভ্যতা এবং জনসাধারণ ও চিকিৎসকদের সচেতনতার কারণে এসব রোগ অনেক বেশি করে নির্ণয় করা যাচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে থাইরয়েডের সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়।
থাইরয়েড আমাদের দেহের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি। গলার সামনে অবস্থিত এই গ্রন্থি দুটি অংশে বিভক্ত, যা একটি সরু অংশ বা ইসথমাস দিয়ে সংযুক্ত। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে তৈরি হয় থাইরক্সিন ও ট্রাই আয়োডো থাইরনিন নামে দুটি হরমোন, যা জীবনভর আমাদের নানা শারীরিক কার্য সম্পাদনের জন্য অত্যন্ত দরকারি। শিশুকালে, এমনকি জন্মের আগে থেকেই শিশুর বৃদ্ধি বিশেষ করে মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য এই হরমোন জরুরি। হূদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, ত্বক, কিডনি, যকৃৎ, পেশি অর্থাৎ দেহের এমন কোনো অঙ্গ নেই, যার বৃদ্ধি ও কাজ করার জন্য থাইরয়েড হরমোনগুলোর সহায়তা লাগে না। থাইরয়েড হরমোনের অভাবে শিশুর জন্মগত প্রতিবন্ধিতা থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা ও যৌবনপ্রাপ্ত হওয়া ব্যাহত হওয়া, বড়দের ক্লান্তি, কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া, দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গন্ডগোল, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, নাড়ি স্পন্দনে সমস্যা, হজম ও কোষ্ঠ সমস্যা, রক্তশূন্যতা, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে ধীরতা, মেয়েদের মাসিক ও গর্ভধারণে সমস্যা ইত্যাদি যেকোনো প্রকারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে সব ধরনের সমস্যায় সব সময় গ্রন্থির আকার বড় হয় না বা চাকা দেখা যায় না। থাইরয়েড গ্রন্থিতে চাকা হওয়ার ব্যাপারটিকে চিকিৎসকদের ভাষায় বলা হয় থাইরয়েড নডিউল, যা কখনো কখনো ক্যানসার হতে পারে বটে, কিন্তু চাকামাত্রই ক্যানসার নয়।
থাইরয়েডে চাকা কী কারণে হতে পারে?: থাইরয়েড নডিউল বা চাকা খুব একটা দুর্লভ ঘটনা নয়। বলা হয়, আমেরিকার জনসংখ্যার শতকরা ৪ ভাগেরই থাইরয়েডে চাকা আছে। আমাদের দেশে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আবার ধারণা করা হয়, সাধারণ জনগণের, বিশেষ করে নারীদের যদি গলার আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করা হয়, তবে শতকরা ৫০ ভাগেরই থাইরয়েডে চাকা পাওয়া যাবে, যদিও তা এমনিতে বোঝা যাচ্ছে না। তবে থাইরয়েডে ৯৫ শতাংশ চাকাই শেষ পর্যন্ত নিরীহ বা ননম্যালিগন্যান্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু ওই রয়ে যাওয়া ৫ শতাংশ ক্যানসারের আশঙ্কার কথা ভেবেই থাইরয়েড নডিউলকে সব সময় একটি বিশেষ বিবেচনায় দেখা হয়। থাইরয়েডে চাকা হতে পারে সাধারণ একটা সিস্ট (তরলপূর্ণ থলে), ঘ্যাগ রোগের অংশবিশেষ, আয়োডিনের অভাবজনিত সাধারণ গয়টার, থাইরয়েডে প্রদাহ, জন্মগত ত্রুটি বা নিরীহ গোছের কোনো টিউমার, যা নিয়ে আদৌ ভয়ের কিছু নেই। আবার এই চাকা হতে পারে থাইরয়েড ক্যানসারের একটি প্রথম এবং কখনো কখনো একমাত্র উপসর্গ, যে ক্যানসার আবার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে চাকাটি নিরীহ, না ক্যানসার, তা বোঝার জন্য রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস, চাকাটির ধরন-ধারণ, আকার-আকৃতি ইত্যাদি এবং কিছু পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কোন চাকাটির ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি: থাইরয়েডের সব সমস্যার মতো চাকাও নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কিন্তু পুরুষের এবং খুব অল্প বয়স আর খুব বেশি বয়সে (যেমন—১৪ বছরের আগে ও ৭০ বছরের পরে) গলায় চাকা হলে তা ভাবনার বিষয় বৈকি। সম্প্রতি গর্ভাবস্থার ইতিহাস ও পরিবারে মা-বোনদের হাইপোথাইরয়েড ও ঘ্যাগ রোগের ইতিহাস থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে এটাও সে রকমই কিছু, ভয়ংকর হয়তো নয়। নিরীহ চাকা সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে একই রকম আছে বা খুব ধীরে বাড়ছে, অন্যদিকে দ্রুত বড় হয়ে ওঠা চাকার ক্যানসার হওয়ার দিকেই ঝুঁকি বেশি। ছেলেবেলায় ঘাড়, মাথা ও গলায় রেডিয়েশন বা বিকিরণ দেওয়ার ইতিহাস থাকাটা খারাপ। অনেক সময় শিশুদের লিমফোমা ও অন্যান্য রোগে রেডিয়েশন দেওয়া হয়। চেরনোবিল দুর্ঘটনার চার বছর পর নিকটবর্তী বেলারুশ এবং আরও কিছু স্থানে হঠাৎ করে থাইরয়েড ক্যানসারের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণই দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এক সেন্টিমিটারের ছোট আকার, নরম চাকা সাধারণত নিরীহ। অপর দিকে মাঝারি শক্ত বা শক্ত চাকা, গলার সঙ্গে সেঁটে থাকা চাকা, দুই সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় আকার, সঙ্গে গলা বা ঘাড়ের অন্যান্য লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া, হঠাৎ করে গলার স্বর ভেঙে যাওয়া বা খাদ্যনালি ও শ্বাসনালি আক্রান্ত হওয়া খারাপ লক্ষণ। রোগীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক বিস্তারিত ইতিহাস জানার পর এবং হাত দিয়ে চাকা ও গলা অনুভব করার পর চিকিৎসকের উচিত প্রথমেই গলার একটি আলট্রাসনোগ্রাফি করা এবং দেহে থাইরয়েড হরমোনের অবস্থা কী, তা রক্তে পরীক্ষা করে নেওয়া। আলট্রাসনোগ্রাফির কিছু রিপোর্ট চিকিৎসকের জন্য খুবই সহায়ক। বর্তমান কালের হাই রেজ্যুলিউশন আলট্রাসনোগ্রাফি এমন সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন চিহ্নিত করতে পারে, যেমন—হাইপোইকোজেনিসিটি (হ্রাসপ্রাপ্ত শব্দতরঙ্গ), এবড়োখেবড়ো সীমানা বা মার্জিন, মাইক্রোক্যালসিফিকেশন বা চাকার ভেতর ক্যালসিয়াম জমাট বাঁধা, চাকার অভ্যন্তরে রক্তনালির অস্বাভাবিকতা বা ক্যাওটিক আচরণ, আশপাশের লসিকাগ্রন্থি, নার্ভ ও অন্যান্য টিস্যুর অস্বাভাবিকতা ইত্যাদি, যা চিকিৎসকের সন্দেহ উসকে দিতে বা দূর করতে খুবই সহায়ক ভূমিকা রাখে। সন্দেহজনক চাকার ক্ষেত্রে এরপর অবশ্যই একটি নিডল বায়োপসি বা এফএনএসি করার প্রয়োজন পড়ে। এতে একটি সূক্ষ্ম সুচ চাকার মধ্যে ঢুকিয়ে খানিকটা টিস্যু বের করে এনে মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা হয়। নিডল বায়োপসি দিয়েও একটি চাকা ক্যানসার কি না, তা পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বর্তমান বিশ্বে হিস্টোপ্যাথলজিস্টরা একটি থাইরয়েড চাকার ক্ষেত্রে মোট পাঁচ ধরনের রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। হয় তাঁরা বলবেন যে এটি পুরোপুরি বিনাইন বা নিরীহ; সে ক্ষেত্রে ফলোআপ করা ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন নেই। অথবা তাঁরা বলবেন যে এতে ক্যানসার সেল পাওয়া গেছে, অথবা পাওয়া যায়নি, কিন্তু অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ সন্দেহজনক, কিংবা এটি একটি ফলিকুলার কোষ দিয়ে তৈরি টিউমার, যা ক্যানসার হতেও পারে, না-ও হতে পারে। এই সব কটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত যাবে অপারেশনের পক্ষে। যদি হিস্টোপ্যাথলজিস্ট বলেন যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে, যা প্রায়ই ঘটে থাকে, তবে পরীক্ষাটি পুনরায় করতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। সাধারণত থাইরয়েড চাকা যদি ক্যানসার হয়, তবে তা থাইরয়েড হরমোনের ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। হরমোনের রিপোর্ট সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকতে পারে। বরং হাইপার থাইরয়েড বা হরমোনের আধিক্য সাধারণত কখনোই ক্যানসারের ক্ষেত্রে ঘটে না।
থাইরয়েড ক্যানসারের চিকিৎসা: থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর চাকায় ক্যানসারের চিকিৎসার সাফল্য নির্ভর করে এর ধরন, ছড়িয়ে পড়ার সীমা ও স্টেজিংয়ের ওপর। যেমন—প্যাপিলারি ক্যানসার যদি কেবল গ্রন্থির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, মানে যথাসময়ে নির্ণয় করা যায়, তবে এর সেরে ওঠার সম্ভাবনা সন্তোষজনক। আবার অ্যানাপ্লাস্টিক বা মেডুলারি ক্যানসারের বেলায় অতটা আশাবাদী হওয়া কঠিন। যেকোনো ধরনের থাইরয়েড ক্যানসারের ক্ষেত্রেই চিকিৎসা হচ্ছে, প্রথমে সার্জারি বা গ্রন্থিটি কেটে ফেলে দেওয়া। এর ফলে শরীরে থাইরয়েড হরমোনের চিরস্থায়ী অভাব পূরণ করার জন্য রোগীকে আজীবন থাইরক্সিন ট্যাবলেট সেবন করতে হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে আজকাল সম্পূর্ণ গ্রন্থি ফেলে না দিয়ে একটি অংশ রেখে দেওয়া হয়, যাতে থাইরয়েড হরমোনের চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে। তবে অস্ত্রোপচার করা হলেই চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়ে যায় না। এ ধরনের রোগীকে ছয় মাস বা এক বছর পর পর বিশেষভাবে ফলোআপ করা হয়, যাতে ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না বা দেহের কোথাও ক্যানসারের কোষ রয়ে গেছে কি না, তা ধরা যায়। এই ফলোআপ অনেক সময়ই জটিল ও বিভিন্ন ধাপে হয়ে থাকে এবং একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন হয়।
সব চাকাই ক্যানসার নয়, তবু সাবধান: থাইরয়েডে চাকা বা নডিউল বহুসংখ্যক মানুষের দেখা যায়, কিন্তু সুখের বিষয় যে এদের বেশির ভাগেরই ক্যানসার নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি এমন সব কারণে হয়ে থাকে, যার সহজ ও নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা আছে। সব চাকাই ক্যানসার নয়, শুধু কিছু কিছু চাকাই ক্যানসার। তাই থাইরয়েডে চাকা দেখা দিলে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, এটি ক্যানসার, না নিরীহ, তা নির্ণয় করা। এই ভেদটি নির্ণয় করা হলে পরবর্তী চিকিৎসায় আর কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। তাই গলার সামনে বা পাশে কখনো চাকাজাতীয় কিছু দেখতে পেলে বা অনুভব করলে অচিরেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং এটি ক্যানসার কি না, তা নিশ্চিত হন। মনে রাখবেন, থাইরয়েডের সমস্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটি এনডেমিক জোন এবং জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে আমাদের দেশে নারীরা এই গ্রন্থির নানা সমস্যায় আক্রান্ত।
তানজিনা হোসেন
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ৩০, ২০১২
Leave a Reply