১৪ বছরের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠতে হলো। কঙ্কালসার বলতে যা বোঝায়, সে তাই। শুকনো, সাদা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। শুকনো শরীরে শুধু ডান হাঁটু ও তার ওপরের কিছু অংশে বেশ ফুলে আছে। সে অংশের তীব্র ব্যথায় বাচ্চাটা ছটফট করছে।
বাচ্চার বাবাকে যখন বলা হলো, আপনি ছেলেটাকে এত খারাপ করে এখন চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আনলেন? বাবা জবাব দিলেন, ‘আমি কী করব? আমি তো আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য চেষ্টা শুরু করেছি, যখন থেকে আমার ছেলে তার অসুখের কথা বলা শুরু করেছে। প্রথম থেকে আমি তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছি।’ তিনি কয়েকজন চিকিৎসকের পেসক্রিপশনও দেখান। তার মধ্যে দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পেসক্রিপশনও আছে। দেখা গেল, অনেক পরে ছেলেটার অসুখ নির্ণয় হয়েছে—Osteosarcoma, যা একধরনের হাড়ের ক্যানসার। কেন এমন হলো? প্রথম থেকে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করার পরও কেন এত দেরি হলো তার সঠিক চিকিৎসার? এর একটা উত্তর হলো আমাদের দেশে রেফারেল সিস্টেমের অভাব।
রেফারেল কী?
চিকিৎসাশাস্ত্রে রেফারেল হলো একজন চিকিৎসক তার কাছে আসা রোগীকে প্রয়োজন মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অপর চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পরামর্শ দেবেন, যাতে রোগী সঠিক চিকিৎসা পায়। পৃথিবীর অনেক দেশে রেফারেল একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা এবং এর জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। সবাইকে সেটা মেনে চলতে হয়। ফলে রোগীকে অযথা অপ্রয়োজনীয় জায়গায় ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট না করে সঠিক সময় উপযুক্ত জায়গা থেকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। সেসব দেশে ঠিকমতো রেফার না করলে চিকিৎসককে যথেষ্ট জবাবদিহি করতে হয়। সাধারণত তিন ধরনের রেফারেল সিস্টেম থাকে। প্রথমত, তাৎক্ষণিক, যা রোগী দেখার সঙ্গে সঙ্গেই করতে হয়। দ্বিতীয়ত, জরুরি, যা কয়েক দিনের মধ্যে করতে হয় এবং তৃতীয়ত হলো সাধারণ, যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে করতে হয়।
বর্তমানে মানুষের সচেতনতা অনেক বেড়েছে। ফলে মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসুখ হলে চিকিৎসকের শরাণাপন্ন হন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অথবা জেনারেল ফিজিশিয়ানদের কাছে যান। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক দিন চিকিৎসা করার পর যখন তেমন উল্লেখযোগ্য সুফল পাওয়া যায় না, তখন রোগীকে অন্য চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো সময় চিকিৎসক প্রথমে রোগীকে সেই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলার পরও রোগী সে পরামর্শ না মেনে তার আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত জনের পরামর্শমতো বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে যায় এবং অযথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভুল চিকিৎসা গ্রহণ করে এবং সময় নষ্ট করে। ফলে উভয় ক্ষেত্রে তার সুচিকিৎসা হয় না। অথচ সফল ক্যানসার চিকিৎসার সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হলো প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক রোগ নির্ণয় করা এবং উপযুক্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে ক্যানসার চিকিৎসায়ও বিভিন্ন বিভাগ তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলাদা বিশেষজ্ঞ আছেন। বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসা এত বিস্তৃত হচ্ছে যে একটা বিষয়ের বিশেষজ্ঞের পক্ষে অন্য বিষয়ের বিস্তারিত ও সবাধুনিক চিকিৎসার জ্ঞান রাখা সম্ভব নয়। যার জন্য এক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ যদি তাঁর নিজের বিষয়ের বাইরের রোগীর ক্যানসার চিকিৎসা করেন, তবে সেটা রোগীর জন্য তেমন কল্যাণকর হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, মোটামুটি চিকিৎসা দিয়ে অনেক দিন পার করার পর শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেন। কিন্তু তখন চিকিৎসা রোগীর জন্য তেমন কোনো সুফল আনে না।
তাই সফল ক্যানসার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ের মধ্যে রোগীকে সঠিক বিশেষজ্ঞ বা প্রতিষ্ঠানে রেফার করা।
মমতাজ বেগম
(সহকারী অধ্যাপক, শিশু ক্যানসার বিভাগ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৪, ২০১২
Leave a Reply