কেবল খেলেই হবে না, খেতে হবে মনোযোগসহ। খেতে হবে অভিনিবিষ্ট হয়ে। তেমন খাওয়া হিতকর। এক লোকমা খাবার মুখে দিন। কী খাবার তা বড় কথা নয়, মনে করুন এমন কোনো খাবার, যা বড় প্রিয়। ভাবুন, গরম গরম স্বাদু ভাপে সিদ্ধ সবজি, সুবাস বেরোচ্ছে…।
এরপর কঠিন কাজ! খাবারে কামড় দিন। প্রথম কামড়। ক্ষুধার্ত, কিন্তু গিলে ফেলবেন না।
লোভ সংবরণ করুন।
ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে খান। কথা বলবেন না। নীরব।
ভাতের সংযুতি অনুভব করুন। ভাপে সিদ্ধ সবজির সুবাস, পাত্রে মাছের ঝোলের রং এবং ধোঁয়া ওঠা সবজির নতুন গন্ধ।
এ রকম চলুক আহারের পুরো পর্ব। তৃতীয় নয়ন মেলে উপভোগ করবেন মনোযোগী খাওয়া। খাওয়ার এই চর্চার মূল রয়েছে মহান বুদ্ধদেবের শিক্ষায়।
নানারকম ধ্যান আছে—উপবেশন, শ্বাসক্রিয়া, দাঁড়িয়ে এবং হেঁটে ধ্যানচর্চা। বৌদ্ধ শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের খাদ্য গ্রহণের সময় ধ্যানচর্চায় উৎসাহিত করেন, প্রতিটি লোকমা গ্রহণের সময় একে গ্রহণের উদ্দেশ্য ও গ্রহণের সময় নিজের অনুভবের প্রতি ঘনিষ্ঠ মনোযোগ দিতে বলেন।
এ রকম একটি চর্চার সময়, ছোট একটি কমলালেবু হয়তো দেওয়া হলো শিক্ষার্থীর সামনে। এর দিকে চেয়ে থাকা, তন্ময় হয়ে একে নিয়ে ভাবা। একে ধরে থাকা এরপর চিবিয়ে খাওয়া—এসব কাজে ব্যয় করতে হবে ১০-২০ মিনিট।
মুখ ও মনের এই চর্চা মুগ্ধ করেছে অনেক বিজ্ঞজনকে: হার্ভার্ড থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার বিদ্বজ্জনদের। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সহজ এই কাজটি বড় হিতকর—ধীরে ধীরে আহার; প্রতিটি কামড় সত্যিকার উপভোগ করে খাওয়া, দৌড়ে দৌড়ে আহার ও নতুন নতুন ফাস্টফুডের জগতে হতে পারে অভিনব একটি অগ্রগতি; স্থূলতা রোধের প্রয়াসে।
মনোযোগী আহার কোনো খাদ্যবিধি নয়, অথবা কোনো খাদ্যের ব্যাপারে বিধিনিষেধও নয়। খাদ্যকে তীব্রভাবে অনুভব করা, এর খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করা। ধরুন, চিজবার্গারই মনোযোগী হয়ে খাচ্ছেন ধীরে ধীরে। একে অনেক বেশি উপভোগ করা যায়। বা এমন হলো, অর্ধেক খাওয়ার পর মনে করলেন বেশ হলো খাওয়া; এবার চাই কিছু সালাদ।
ওরেগনে শিশুচিকিৎসক ও ধ্যানচর্চা শিক্ষক জ্যাম চোজেন বেজ, যিনি ‘মাইন্ডফুল ইটিং: অ্যা গাইড টু রিডিসকভারিং অ্যা হেলদি অ্যান্ড জয়ফুল রিলেশনশিপ উইথ ফুড’ গ্রন্থেরও প্রণেতা, তাঁর বক্তব্য: ‘আমি মনে করি, মূল সমস্যা আমরা যখন খাই, অমনোযোগী হয়ে যাই।’
সচেতন হয়ে খাওয়া সম্পর্কে গত কয়েক বছর অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে; ব্লগ ও ভিডিও তৈরি হয়েছে, হার্ভার্ডের একজন পুষ্টিবিদ লিলিয়ান চেউং এর সুফল নিয়ে বেশ কাজ করেছেন এবং স্বাস্থ্যপরিচর্যাকারীদের এই চর্চা বাস্তবে প্রয়োগের জন্য প্রবল তাগিদ ও অনুরোধও করছেন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান ভ্যানসিংক, যিনি ‘মাইন্ডলেস ইটিং: হোয়াই উই ইট মোর দ্যান উই থিঙ্ক’ গ্রন্থটি লিখে খ্যাত। তিনি অমনোযোগী হয়ে গোগ্রাসে গেলার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বিশ্লেষণও করেছেন।
মনোযোগী আহার আমাদের জীবনযাপনের অংশ হলে সুস্থ থাকা, চাপমুক্ত উদ্বেগহীন জীবনযাপন অনেক সহজ হবে বলে মনে করেন অনেকে।
জীবনের ছন্দ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে: নিজেদের খেয়াল নেওয়ার মতো সচেতনতা ও সামর্থ্য কমছে আমাদের। তাই মনোযোগী আহার হয়ে পড়ছে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের মনে কেবল থাকে কী খাচ্ছি। পুষ্টিকর খাদ্যের সমাবেশ ঘটালাম, কিন্তু কীভাবে খাব; তা নজর করলাম না। খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেলে, খাবারের স্বাদ, সুবাস উপভোগ করে মনে লাগিয়ে নীরবে খেলে, সেই খাওয়া শরীরে লাগে।
মনোযোগী খাওয়া, মন লাগিয়ে খাওয়া হলো ব্লু ক্লিক মঠে, নিউইয়র্কে। ম্যানহাটান থেকে ৭৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে শান্ত আশ্রয়ে, কৌতূহলী মানুষ যোগ দিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী লোকদের সঙ্গে সপ্তাহে দুই দিন নিখরচা ‘মনোযোগী দিবসে’। সমাগত লোকজন প্রথম দেখলেন টিকনায়ট হান নামে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ভিডিও বক্তৃতা, যিনি এ ধরনের মঠের প্রতিষ্ঠাতা। চলতে চলতে ধ্যান করে তাঁরা খাওয়ার ঘরে ঢুকলেন মধ্যাহ্ন আহারের জন্য।
কারও মুখে কথা নেই, শুধু খাওয়া, কথা বলা নয়, টিভি দর্শন নয়, ফোনে গল্প করে করে খাওয়া নয়: ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট করে করে খাওয়া নয়। মন লাগিয়ে খাওয়া।
দীর্ঘ বুফে টেবিল সাজানো: সবজি খাবার, সন্ন্যাসীরা মন লাগিয়ে তৈরি করেছেন; মাইন্ডফুলনেস রোড সাইন দেখে পৌঁছানো যায় মঠে, অবশেষে খাবার টেবিলে। প্লেটে খাবার, মেশানো হলো সস: সবাই একত্রে বসলেন চোখ বোজা, ধ্যানরত: এরপর কিছুক্ষণ বিমুগ্ধ, রহস্যময় কিছু সময়: কাটা চামচের টুং টাং, চামচ ও চপস্টিকের শব্দ, ব্লু ক্লিফ সংঘের মধ্যাহ্ন আহার অতিবাহিত হলো: মধ্যাহ্ন আহারে সবজি, মসলা, কচকচে খাবার, নোনা স্বাদ, উষ্ণতা, কোমলতা এবং সংগীতের সাহচর্য উপভোগ করলেন সবাই। কেউ কেউ ভাবলেন খাবারের উৎসের কথা: হাজার হাজার খামারি কৃষকের কথা, ট্রাকচালক ও শ্রমিকের কথা, যাঁদের মিলিত চেষ্টায় ভোজনের জন্য এসেছে এ খাদ্য…।
তাঁদের চোয়ালগুলো ধীরে ধীরে ওঠে নামে: তাঁদের মুখমণ্ডলে গভীর মনোযোগের আভাস: প্রতিটি সময় একটি বিরতির মধ্যেও আসে বিরতি: মাঝেমধ্যে চর্বণ করাও গলাধঃকরণের বিরাম হয়; চেতনার গভীরে চলে যাওয়ার জন্য।
এমন আহার চর্চা বেশ চ্যালেঞ্জিং: মানুষ দ্রুত খেতে অভ্যস্ত; থেমে থেমে খাওয়া ও ধীরে ধীরে খাওয়া—এ হলো নতুন চর্চা। মনোযোগী খাওয়া হলে অতিভোজন হয় না।
দ্রুত খেলে গপগপ করে অনেক গিলে মানুষ, তবু পেট ভরা হয় না। হার্ভার্ড স্কুলের পুষ্টিবিদ লিলিয়ান চেং তাই মনোযোগী আহারের প্রবক্তা; অতিভোজনের বিরুদ্ধে একটি মনোগত বাধা মনে করেন একে তিনি। তবে ঘরেই মনোযোগী আহারে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হওয়া সম্ভব। সবাই মঠে বসে একত্রে এমন আহারের সুযোগ পাবেন কই, বলেন লিলিয়ান চেং। চর্চাটা চালাতে হবে।
শিশুবিশেষজ্ঞ বেইস বলেন, প্রতিদিন হয়তো মনোযোগী আহার সম্ভব নয়, সপ্তাহে এক দিন সে চর্চা করা যায়। টিভি সেট বন্ধ করে একদিন প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে একত্রে খেতে বসুন। খাওয়া উপভোগ করুন।
‘কেমন হয় প্রথম পাঁচ মিনিট আমরা খাই নিঃশব্দে, এবং সত্যি উপভোগ করি খাদ্য?’ বেইস বলেন, ‘এভাবে ধাপে ধাপে আমরা এগোব।’ প্রতি বেলার খাবার এভাবে হয়তো খাওয়া যাবে না। তাতে কী? তিন চুমুক চা মনোযোগ দিয়ে পান করুন: এরপর চলে যান কাজে। যে কেউ তা করতে পারেন, যেকোনো স্থানে।
আমাদের দেশের খাবার সুবাসিত। সরষের গন্ধ, পাঁচফোড়নের গন্ধ, ধনেপাতা, পালংশাকের গন্ধ… আমাদের মনোযোগী আহারে প্রবৃত্ত করতে পারে বটে। প্রয়োজন একটু প্রচেষ্টা।
তবে মনোযোগী আহার করব বললেই হয় না। চাই চর্চা। ধীরে ধীরে এগোনো।
যখন খাবেন কেবলই খাবেন
টিভির প্লাগ খুলে ফেলুন। নজর কেবল খাদ্যের দিকে, কেবলই খাদ্যের দিকে। নীলকণ্ঠ পাখির গলার দিকে নজর করে যেমন লক্ষ্য ভেদ করেছিলেন অর্জুন।
নীরবতা বিবেচনা করুন
অনেক পরিবারে বিশেষ করে ছোট বাচ্চারা ৩০ মিনিট নীরব হয়ে খাবে, তা বেশ কঠিন কাজ। তবে কিছু সময় নিঃশব্দে খাবার অভ্যাস করা যায়।
সপ্তাহে এক দিন চেষ্টা করুন
অনেক সময় দ্রুত খেতেই হয়। কাজের ব্যস্ততার জন্য। সপ্তাহের অন্তত এক দিন শান্ত হয়ে বসে নীরবে আহার উপভোগ করুন। মন লাগিয়ে। এই অন্তদর্শন মনোযোগ কাজে প্রেরণা জোগাবে।
বাড়িতে এক চিলতে জায়গা থাকলেও বাগান করুন, ঘরে রান্না করে খান
খাদ্য প্রস্তুত করার প্রক্রিয়ায় যেকোনোভাবে যুক্ত হলে মনোযোগী আহারে আকর্ষণ বাড়ে।
ধৈর্য ধরে খাদ্য চর্বণ করুন
সহজ নয়, তবে ধীরে ধীরে চিবিয়ে খান, খাবারের একটি লোকমা অন্তত ২৫-৩০ বার চর্বণ করুন।
ব্যবহার করুন পুষ্প ও মোমবাতি
নৈশ আহারের আগে টেবিলে রাখুন ফুল আর জ্বালান মোমবাতি। শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। The moment of gratitude অনেকে বলেন একে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী,
পরিচালক,
ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল,
সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৮, ২০১২
KAMRUL
Onak Balo laglo .
িরনা
অামার ছোট বোন বয়স ১৮, সে এ কেবারে খে তে চাই না। দয়া ক রে বল বেন কি কর তে পারি।
ধন্যবাদ
Bangla Health
খেতে না চাওয়া কারণ অবশ্যই আছে। তিনি যদি নিজে থেকে খেতে চান না, যেমন ধরুন যদি মনে করেন যে খেলে মোটা হয়ে যাবেন- এমন কিছু, তাহলে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে মানুষ খেলেই মোটা হয় না। মোটা হয় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি খেলে বা অপুষ্টিকর খাবার খেলে।
যদি শারীরিক কারণে না খেয়ে থাকেন তাহলে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করানো উচিত।