তিন মাস বয়সের ছোট্ট নবজাতককে নিয়ে এসেছেন একজন মা। শিশুটির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। জন্মের পর থেকেই এ সমস্যা। শিশুবিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়েছে। তিনি ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী চোখে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। মায়ের আকুতি! কী জানি, কোনো শক্ত অসুখ হয়েছে কি না, কে জানে! নতুন করে ব্যবস্থাপত্র নেন চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। মাকে বলা হয়, নিয়মিত ওষুধ দিতে এবং নাকের পাশে মালিশ করতে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মা তা করেছেন। কিন্তু এবারও তেমন কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
শিশুর বয়স বাড়ে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে মায়ের দুশ্চিন্তা—বাচ্চাটার চোখ ভালো হবে তো? আবার যান চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেন। মা জানতে চান, চোখের অবস্থা কী? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সময় নেই। জবাবের আশায় কিছুক্ষণ বসে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিদায় হন মা।
ওপরের চিত্রটি এ দেশে মোটামুটি পরিচিত। চক্ষুবিশেষজ্ঞের চেম্বারে কিংবা হাসপাতালের চক্ষু বহির্বিভাগে শিশুর এ সমস্যা নিয়ে অনেক মা উপস্থিত হন। এ অসুখটি তেমন জটিল কোনো রোগ নয়। বলা যায়, অনেকটা পরিচিত রোগ। রোগটি ‘নালিরোগ’ নামে পরিচিত। বিশেষ করে বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। ছোট শিশুদেরও যে এ রোগটি হতে পারে, সে ধারণা অনেকেরই নেই। জন্মের সঙ্গে রোগটি সম্পর্কিত বিধায় এটি জন্মগত নালিরোগ নামে অভিহিত। নবজাতক শিশুদের ভেতর শতকরা ২০ জন শিশু জন্মগত নালিরোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা থাকলে এ ক্ষেত্রে উৎকণ্ঠা অনেকটা কমবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের চোখে অশ্রুপ্রবাহ সতত বিদ্যমান। অশ্রু তৈরির কিছু গ্রন্থি রয়েছে। সেসব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অশ্রু চোখের সম্মুখভাগকে সিক্ত রাখে। নিঃসৃত অশ্রুর একটি অংশ বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। আরেক ভাগ অশ্রুনালির মাধ্যমে নাকের ভেতর যায়। সেখান থেকে কিছুটা গলায় প্রবেশ করে, যে কারণে চোখে কোনো ওষুধ দিলে তা কিছুক্ষণ পর গলদেশে প্রবেশ করে বিধায় আমরা ওষুধের স্বাদ পাই। যাদের অশ্রু নির্গমনপথ স্বাভাবিক, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু যাদের নালিপথ বন্ধ থাকে, তারা তা পায় না। নালিপথ বন্ধ থাকার দরুন অশ্রু জমা হয়ে তা নালিপথে প্রদাহের সৃষ্টি করে, যা নালিরোগ নামে পরিচিত। চোখ দিয়ে পানি পড়া, কেতর জমা হওয়া বা পুঁজ পড়া নালিরোগের লক্ষণ। নবজাতক শিশুদের নালিপথ জন্মগতভাবে বন্ধ থাকলে এসব লক্ষণ দেখা দেয়। মা-বাবা শিশুর চিকিৎসার্থে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। চোখে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ ও মালিশ ঠিকমতো দেওয়া হলে অনেক ক্ষেত্রে তা নিরাময় করা সম্ভব হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
সাধারণত দেড় বছরের মাথায় ছোট অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার বলতে যে রকম চিত্র চোখের সামনে ভাসে, এটি কিন্তু সে রকম কিছু নয়। মাত্র পাঁচ মিনিটের ভেতরে তা শেষ করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের কথা শুনে মা-বাবা ভীত হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে অন্যত্র ছোটেন বা চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এতে রোগটির নিরাময় ঘটে না। ফলে পরবর্তী সময়ে জটিল অস্ত্রোপচার ছাড়া তা সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, রোগটির প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসায় তা নিরাময় করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নবজাতকের মা-বাবার সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মা-বাবাকে বুঝতে হবে, এটি মারাত্মক কোনো রোগ নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমে এ রোগের নিরাময় সম্ভব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। শিশুবিশেষজ্ঞ ও চক্ষুবিশেষজ্ঞ উভয়কেই এ ক্ষেত্রে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে আমাদের চিত্রে উল্লিখিত শিশুটির মা-বাবার উৎকণ্ঠা থেকে যায়, যা সুচিকিৎসার জন্য কাম্য নয়।
মো. শফিকুল ইসলাম
অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২১, ২০১২
Leave a Reply