করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কর্মকর্তা ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের ছয় মাস বয়সী প্রথম সন্তানকে কোলে নিয়ে চিকিৎসকের চেম্বারে এসে ঢোকেন। পরম আদরের ধন বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে মা তার মাথাটি ঢেকে রেখেছেন বড় একটি তোয়ালে দিয়ে। তোয়ালেটি সরিয়ে তরুণ পিতা তাঁর সন্তানের বেশ বড় আকৃতির মাথা দেখিয়ে পরম আকুতিতে বলে ওঠেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আমার একমাত্র ছেলের কী অবস্থা দেখেন!’ ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলতে শুরু করেন, এই রোগটির নাম হাইড্রোকেফালাস। হাইড্রো অর্থ পানি। কেফালাস অর্থ মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কে পানি জমে যাওয়াকেই বলা হয় হাইড্রোকেফালাস।
ডাক্তার সাহেব আরও বলেন, আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগেও মিসরীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ রোগের বর্ণনা দিয়েছিলেন। শিশুর পিতা জিজ্ঞেস করছিলেন, কেন এমন হয়?
উত্তরে চিকিৎসক বলেন:
অতিমাত্রায় পানি তৈরি হওয়া
পানি রক্তের সঙ্গে মিশতে না পারা
মাথার মধ্যে রোগজীবাণু ঢুকে ম্যানিনজাইটিস হলে
আবার কখনো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, রোগজীবাণু সংক্রমণ, টিউমার হলে
জন্মগতভাবে পানি চলাচলের রাস্তা সরু থাকা
—এসব কারণে হাইড্রোকেফালাস রোগ দেখা দিতে পারে।
তখন এই রোগের ফলে মাথার আকৃতি অনেক বড় হওয়ার ব্যাপারটা মাথার মাপ নিলে সঠিকভাবে বোঝা যায়। মাথার এই মাপকে ওএফসি (অক্সিপিটো ফ্রন্টাল সারকামফারেন্স) বলা হয়। জন্মের পর সাধারণত ৩৭ সেন্টিমিটার, পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বড় হয়ে তিন বছরে ৫২ সেমি হয়ে থাকে। বলা হয়, তিন বছরের বাচ্চা ও তার বাবা একই মাপের টুপি পরতে পারে। মাথার মাপ নেওয়ার জন্য একটি দর্জি দোকানের ফিতা থাকলেই যথেষ্ট। তবে মাপ নেওয়া এবং সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুদের মাথার সামনের দিকে যে জায়গাটা সাধারণত নিচু ও নরম থাকে, সে জায়গা পানির চাপের কারণে উঁচু হয়ে যায়। তখন এই রোগের অবস্থা ও কারণ সঠিকভাবে বোঝার জন্য মাথার আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার প্রয়োজন হলে সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করতে হয়। একই সময় পিঠের নিচের দিকে ম্যানিঙ্গোসিল নামক কোনো রোগ হয়েছে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এসব কথা বলতে না বলতেই রোগীর মা-বাবা একসঙ্গে জানতে চান, আদৌ এ দেশে এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা করা সম্ভব কি না।
স্মিত হেসে চিকিৎসক উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের দেশে এখন এই রোগের অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুন্দরভাবে করা সম্ভব। প্রথাগতভাবে, একটি অতিসরু টিউব মাথার ভেতর থেকে পেটের ভেতর দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় যার মাধ্যমে জমে থাকা অতিরিক্ত সিএসএফ মাথা থেকে বের হয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। টিউবের মধ্যে একটি বাল্ব বা কপাটিকা থাকে যার ফলে মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় পানি অতিমাত্রায় বেরিয়ে যেতে পারে না। টিউবটি চামড়ার নিচে বসানো থাকে, ফলে বাইরে থেকে দেখা যায় না।
এই অপারেশনে কিছু জটিলতা হতে পারে, যেমন ইনফেকশন হয়ে টিউব বন্ধ হয়ে যাওয়া, টিউব খুলে যাওয়া, খাদ্যনালিতে প্যাঁচ পড়া। যদিও এসব জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে এসেছে ইটিভি নামে অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, যেখানে মাথায় ছোট একটি ছিদ্র করে ব্রেনের ভেতরে থার্ড ভেন্ট্রিকল নামের পানিপূর্ণ গহ্বরের নিচে একটি সূক্ষ্ম ছিদ্র করে দিলে অতিরিক্ত পানি নতুনভাবে তৈরি এই পথ দিয়ে গিয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এন্ডোসকোপ যন্ত্রের মাধ্যমে টিভির পর্দায় দেখে অস্ত্রোপচার করা হয়।
তবে এই অস্ত্রোপচার সব রোগীর জন্য সুফল বয়ে আনে না। আপনার বাচ্চার সিটি স্ক্যান করা হলেই আমি ইটিভি নাকি সান্ট কোনটা ভালো হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
পরীক্ষা শেষে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিলেন, শিশুটির জন্য আধুনিক চিকিৎসা করা যেতে পারে। সব পরীক্ষা শেষে অপারেশন করে রোগী বাড়ি যাওয়ার আগের দিন বাচ্চার মা-বাবা, নানা-নানি, দাদা-দাদিসহ আরও অনেকে চিকিৎসকের চেম্বারে উপস্থিত হলেন। নানি বললেন, ‘আপনি আমাদের সামাজিক লজ্জা থেকে মুক্তি দিলেন।’ দাদি বললেন, ‘আপনি আমার সোনার মানিককে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সবার মুখে হাসি ফুটল।’
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাচ্চার দাদা যিনি আধুনিক চিকিৎসার পক্ষপাতী ছিলেন, তিনি জানতে চাইলেন, কীভাবে এই রোগ থেকে ভালো থাকা যায়।
উত্তরে চিকিৎসক বললেন:
প্রসূতি মায়ের নিয়মিত চেকআপ
বাচ্চা গর্ভে থাকাকালীন ফলিক এসিড নামের ভিটামিন নিয়মিত গ্রহণ করা
বিজ্ঞানসম্মত প্রসবক্রিয়া অনুসরণ করা
নবজাতকের সঠিক যত্ন নেওয়া
মেনিনজাইটিস রোগের সঠিক চিকিৎসা
ওপরের ব্যবস্থার মাধ্যমে হাইড্রোকেফালাস রোগের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।
সুদীপ্ত কুমার মুখার্জি
নিউরোসার্জন, শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতাল, খুলনা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২১, ২০১২
Leave a Reply