বদলাচ্ছে পরিবেশ, বদলাচ্ছে জীবনাচার; বদলেযাচ্ছে রোগবালাইয়ের ধরন। আবির্ভাব-পুনরাবির্ভাব ঘটছে নতুন নতুন রোগবালাইয়ের। বাড়ছে জনস্বাস্থ্য ব্যয়।দৈনন্দিন জীবনে আচরণ না পাল্টালে জনস্বাস্থ্য-সুরক্ষা দুরূহ হয়েযাবে। নতুন নতুন রোগবালাই প্রতিরোধে জীবনাচার বদলানো জরুরি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছে রোগবালাইয়ের ধরন। সামগ্রিকভাবে গোটা দুনিয়ায় কমছে সংক্রামক রোগ আর বাড়ছে অসংক্রামক রোগবালাই। জলবায়ুর পরিবর্তন, জীবনাচারে পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন আর জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন রোগবালাইয়ের উদ্ভব ঘটছে। কিছু কিছু রোগের পুনরাবির্ভাব ঘটছে।
আসছে নতুন নতুন ভাইরাস
জনস্বাস্থ্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন অণুজীবের কারণে মহামারি দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে নভেল (আগেছিল না এমন) ভাইরাসের উদ্ভব জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন রোগের। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিশ্ববাসী তথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব নতুন (ইমার্জিং) এবংপুনরাবির্ভূত (রি-ইমার্জিং) রোগবালাই নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেজনসংখ্যা এবংঘনবসতির কারণে এ ধরনের নতুন নতুন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই আসন গেড়ে বসতে পারে।
প্রাণীবাহিত রোগ
জুনুটিক ডিজিজ। গোটা দুনিয়ায় জনস্বাস্থ্যেরক্ষেত্রে জুনুটিক ডিজিজ বা প্রাণীবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব হরহামেশাই ঘটছে। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে অ্যানথ্রাক্স নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়েছে। সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় এটি পশু থেকে মানুষে ছড়াতে পারেনি তেমনভাবে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তোলপাড় হয়েছেফ্লু মহামারি নিয়ে। এইচফাইভএনওয়ান কিংবা এইচওয়ানএনওয়ান ভাইরাসজনিত বার্ড ফ্লু এবংসোয়াইন ফ্লু নিয়ে গোটা বিশ্বে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে ছিল। আগাম সতর্কতা, জনস্বাস্থ্যের রোগ-নিরীক্ষণ এবংআন্তর্জাতিক উদ্যোগের কারণে এগুলো অতীতের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রের বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবংএ বিষয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন, আইইডিসিআর) সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।
নতুন নতুন ফ্লু
পাল্টে যাচ্ছে ভাইরাস জ্বর।ভাইরাসের ধর্মই হচ্ছে প্রতিনিয়ত এর চরিত্র বদল, আদল পরিবর্তন। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সময়নিত্যনতুন ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে; কখনো ছড়ায় প্রাণীর মাধ্যমে, কখনো বাতাসে। সিজনাল ফ্লু প্রতিরোধে উন্নত বিশ্বে টিকার ব্যবস্থা রয়েছে। বছরে একবার এই টিকা নিলে ঋতুভিত্তিক ফ্লুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশেব্যাপকভাবে এর প্রচলন নেই। তাই আমাদের প্রতিরোধবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ফ্লু প্রতিরোধে
হাঁচি-কাশিতে ছড়ায়। তাই হাঁচি-কাশির সময়হাতের কনুই উঁচু করে মুখ-নাক ঢাকতে হবে।আর সম্ভব হলে দিনে চার-পাঁচবার দুই হাত উভয়দিকে সাবান দিয়ে ভালোভাবে ফেনা তুলে ধুতে হবে। একই টিস্যু কয়েকবার ব্যবহার না করা বা রুমাল প্রতিদিন গরম পানিতে ধোঁয়ার মতো ছোট ছোট আচরণ পরিবর্তন করলে অনেক সাধারণ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
ভেক্টরবাহিত রোগ: চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, কালাজ্বর
মশা-মাছি দিয়ে ছড়ানো এই রোগগুলো বাড়ছে, দেখা দিচ্ছে নতুন করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আমাদের দেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেড়ে যায়। নগরায়ণের ফলে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি বেড়ে গিয়ে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে।শুরুর দিকে এর চিকিৎসা-ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট আপ-টু-ডেট না থাকায় কিছু প্রাণহানিও ঘটে। পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এটি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর প্রকোপ না কমলেও চিকিৎসা-ব্যবস্থাপনার মান বেড়েছে। ডেঙ্গুর পর সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে, যার নাম—চিকুনগুনিয়া।
বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতে এর প্রাদুর্ভাব ছিল; আমরা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছিলাম, এটি বাংলাদেশেও ঢুকবে। দুই বছর ধরে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন এমন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের ত্রিদেশীয় উদ্যোগে এই অঞ্চল কালাজ্বরমুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাটির ঘরের বেলেমাছি কালাজ্বর ছড়ায়। এতে যকৃৎ (লিভার) ও প্লীহা (স্প্লিন) বড় হয়ে যায়। সময়মতো চিকিৎসায় রোগ ভালো হয়।
ভেক্টর প্রতিরোধে
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে মশা প্রতিরোধ করতে হবে। জমে থাকা পরিষ্কার পানি কিংবা নর্দমার পানিতে প্রতিনিয়তই স্প্রে করতে হবে। যে এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে, সেই এলাকায় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য। কালাজ্বর প্রতিরোধে রোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে মাটির দেয়ালের বা মাটির মেঝের বাড়িগুলোতে মাটি থেকে ছয়ফুট উচ্চতা পর্যন্ত ওষুধ স্প্রে করে বেলেমাছি নির্মূল করতে হবে।
এমডিআর যক্ষ্মা
যক্ষ্মার চিকিৎসা আছে সম্পূর্ণভালো হওয়ার। তবু যক্ষ্মা বাড়ছে নতুন ধরনের। সময়মতো ওষুধ না খাওয়া এবংঅসম্পন্ন চিকিৎসার জন্যমাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা এমডিআর যক্ষ্মার প্রকোপ বাড়ছে।
পুরো কোর্স সম্পন্ন না করে ওষুধ ছেড়ে দেওয়ার ফলেএই যক্ষ্মা পুনরায় দেখা দিচ্ছে। এতে চিকিৎসা ব্যয়বেড়ে যাচ্ছে এবংওষুধের কার্যকারিতাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এমডিআর প্রতিরোধে
যক্ষ্মার ওষুধগুলো নিয়মিত, সময়মতো পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। যদি কেউ মাঝপথে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েথাকেন, তাহলে অতিসত্বর পুনরায় চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
বাড়ছে এনসিডি বা অসংক্রামক রোগ
নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ বা অসংক্রামক রোগ বাড়ছে বাংলাদেশেও। কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া, দ্রুত নগরায়ণ, পরিবেশদূষণ এবংতেল-চর্বিজাতীয় খাবারে আসক্তির কারণে এনসিডি বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, আর্সেনিকোসিস, হাইপারলিপিডেমিয়া, শ্বাসনালির বিভিন্ন রোগ, মনোবৈকাল্য, মনোসামাজিক চাপ ইত্যাদি রোগবালাই ও স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিনিয়তই বাড়ছে।ভবিষ্যতে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইল।
প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ
মানুষ বাড়ছে, পরিবেশ পাল্টাচ্ছে। রোগবালাই বাড়ছে, অণুজীবের ধরন পাল্টাচ্ছে। নগরায়ণ বাড়ছে, জীবনযাত্রার ধরন পাল্টাচ্ছে। এখন আমরা যদি আমাদের আচরণ না পাল্টাই, চারপাশের পরিবেশকে স্বাস্থ্যবান্ধব না করি, তবে নিত্যনতুন রোগবালাই আমাদের ভোগাবে। বাড়ছেস্বাস্থ্য ব্যয়;বাড়বে বৈকল্য। আসুন, আচরণ পাল্টাই পরিবেশ রক্ষায়, নিজেদের রক্ষায়। প্রথম আলোর ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ স্লোগান সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যের সুরক্ষায়।
ইকবাল কবীর
সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৪, ২০১২
Leave a Reply