৮ মার্চ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবারের দিবসের স্লোগান হচ্ছে: ‘কিডনি দান করুন এবং জীবন বাঁচান’। কিন্তু এই মহৎ স্লোগানের মর্মকথা সম্পর্কে আমাদের বাংলাদেশে কত জন মানুষ সচেতন আছি? আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ, বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম ও জনগণ কি অবগত আছে, বাংলাদেশে শিশু কিডনি রোগীর সংখ্যা কত? এর মধ্যে কাদের কিডনি সংযোজন প্রয়োজন, কারা কিডনি দান করতে পারে এবং বাংলাদেশে বিকল কিডনি শিশু রোগীদের কিডনি সংযোজনের কোনো বন্দোবস্ত আছে কি? সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ ব্যাপারে যদি সমাজে সচেতনতা ও দেশে বিকল কিডনি শিশু রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা না যায়, তবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাংলাদেশের বিকল কিডনি শিশু রোগীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে। যাদের সামর্থ্য আছে, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে তারা চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হবে। তবে চলুন, আমরা সবাই মিলে বিশ্ব কিডনি দিবস সামনে রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, শুধু বাহ্যিক বক্তৃতানির্ভর গতানুগতিক অনুষ্ঠান পালন না করে এ দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু কিডনি রোগী (প্রায় ৪৫ লাখ), বিশেষ করে হতভাগা বিকল কিডনি শিশু রোগীর চিকিৎসার সুযোগ শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছড়িয়ে দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা নিই। এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ করতে সবার আগে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে শিশু কিডনি রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ ও শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞদের অবস্থান বহুলাংশে শুধু রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার প্রতি আলোকপাত করা যাক। এই বিভাগে বর্তমানে ২৪টি শয্যা আছে, যা রোগীর সংখ্যানুপাতে নিতান্তই অপ্রতুল। শিশু কিডনি বহির্বিভাগে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী দেশের দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসার জন্য আসে। বহির্বিভাগে একজন অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগীদের চিকিৎসার জন্য এখানে দুটি হিমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত নার্সের সাহায্যে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওয়ার্ডে হঠাৎ বিকল কিডনি রোগীদের পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের এই ক্ষুদ্র ও আন্তরিক প্রচেষ্টা দেশের বিশাল শিশু কিডনি রোগীদের জন্য অতি সামান্য। এখানে উল্লেখ করার মতো শিশু কিডনি বিভাগের অর্জনের কথা দেশবাসীকে জানানোর যে আবশ্যকতা আমরা মনে করি, তা হলো, এ পর্যন্ত তিনজন সম্পূর্ণ বিকল কিডনি রোগীকে সব নিয়মকানুন মেনে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাদের কিডনি বর্তমানে ভালোভাবে কাজ করছে। এগুলো শারীরিক ও বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে চেকআপ করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের শিশু কিডনি রোগীদের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন এখনো সহজলভ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো, শিশু কিডনি রোগ সম্পর্কে লোকজন, এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। কারও কারও মধ্যে এমন ভুল ধারণাও বিদ্যমান আছে যে, বয়স্ক ব্যক্তিদের মতো শিশুদের কিডনি বিকল হয় না। এ ছাড়া কিডনি রোগ শনাক্তকরণের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা না থাকা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও মোটিভেশনের অভাব প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিগণিত। এ ছাড়া আমাদের দেশের অঙ্গ প্রতিস্থাপনবিষয়ক আইন অনেক রোগীর অভিভাবক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আইন কিছুটা শিথিল করার দাবি রাখে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু কিডনি রোগ বিষয়ে দুটি স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। এর মধ্যে একটি এমডি ডিগ্রি এবং অন্যটি রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম। সাতজন চিকিৎসক এমডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত আছেন। কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই তাঁরা কাজ করছেন।
বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে শিশু কিডনি বিভাগ শিশুদের কিডনি রোগ শনাক্তকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। হয়তো এদিন এমন কোনো ভাগ্যবান শিশু কিডনি রোগী প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হবে, যে সম্পূর্ণ কিডনি বিকল হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় কিডনি রোগ শনাক্তকরণ কর্মসূচি সফলতার মুখ দেখবে—এ প্রত্যয় ব্যক্ত করে লেখা শেষ করছি। আসুন, আমরা শিশুদের কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করি। সম্পূর্ণরূপে বিকল হওয়া থেকে তাদের কিডনিকে বাঁচাই এবং সুস্থ জাতি উপহার দিই।
মো. হাবিবুর রহমান ও গোলাম মাঈনউদ্দিন
অধ্যাপক, শিশু কিডনি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৭, ২০১২
Leave a Reply