সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি হলো ‘শ্বাসক্রিয়া’। একে আমরা প্রায়ই নজরে আনি না। মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে অবিরাম, মিনিটে ১৫-২০ বার; পুরো দিন, প্রতিদিন, যত দিন বেঁচে থাকি। শ্বাসকর্মটি স্বয়ংক্রিয় এবং প্রতিবর্ত ক্রিয়া বটে।
চাপ হলো সমস্যা: অক্সিজেন হলো সমাধান: স্বাস্থ্যহিতকর শ্বাসক্রিয়া হলো এক গভীর, শরীরের ভেতরকে পরিচ্ছন্ন করার মতো গভীর শ্বাস চলাচল বটে। দৈনন্দিন যা হয়, আমরা প্রত্যেকে শ্বাসকার্য চালাই অগভীরভাবে, আমাদের ফুসফুসের ক্ষমতার সামান্য শতাংশ কেবল ব্যবহূত হয়। আমাদের শরীরের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন, এর অংশবিশেষ মাত্র গ্রহণ করি এভাবে। পূর্ণশ্বাস যেন নেওয়া হলো। আমরা জানি শ্বাসক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় কিন্তু এর মানে এই নয়, এর কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। একটি ব্যস্ত, ব্যতিব্যস্ত জীবনে, চাপের কারণে অগভীর শ্বাসক্রিয়া চলে সারা দিন। এমন ধরনের শ্বাসক্রিয়া একসময় হয়ে যায় অভ্যাস। যখন মনে-শরীরে চাপ নেই, তখনো অগভীর শ্বাসক্রিয়া চালাই আমরা, তবে শ্বাসক্রিয়া সচেতনভাবে, স্বেচ্ছায় চালাতে যদি চাই, তাহলে ঘটবে অন্য ঘটনা। এমন পরামর্শ রয়েছে বিজ্ঞজনদের।
চাপকে: মূলকথা হলো, আমাদের শ্বাস নিতে হবে বেশি বেশি অক্সিজেন গ্রহণের জন্য। মনে রাখা ভালো, প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময় আমরা করছি একটি স্বাস্থ্যকর্ম। কেবল স্বাস্থ্যমূল্য বিচার করেই নয়, শ্বাস গ্রহণ-বর্জন কাজটি যেন মনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো ব্যাপার, ভিন্নভাবে চিন্তা করার জন্য মনকে তৈরি করা, এরপর সেই প্রশিক্ষণকে কাজে রূপান্তরিত করা। এরপর একটি উদ্দেশ্যমূলক, উত্তমমাত্রায় শ্বাসক্রিয়া যেন হয় দৈনন্দিন অভ্যাস।
নিজের চাপকে উড়িয়ে দেওয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে: সম্পর্কটি এ রকম: নিজে চাপের অধীন যখনই, তখন হয়তো গভীরভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলে দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো। উল্টো পিঠে, আমাদের জীবনে যদি চাপের জন্য চলে কঠিন সময়, তখন অগভীর শ্বাস চলতে থাকে, চলতেই থাকে, কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবিলার মতো পুষ্টিকর অক্সিজেন শরীর পায় না ঠিকমতো।
কেন প্রয়োজন প্রতিদিন গভীর শ্বাসক্রিয়া: দেহের প্রতিটি কোষের জন্য চাই অক্সিজেন। আমাদের রয়েছে হূদ্যন্ত্র ও রক্তনালি। প্রতিটি কোষে অক্সিজেনকে সরবরাহ করা ও রক্তের অক্সিজেনকে ভারমুক্ত করার কাজ বহমান রক্তের এই অক্সিজেন একটি ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে সব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার; খাদ্য রূপান্তরিত হয় শক্তিতে। অক্সিজেন তো তাই জীবন।
শরীরের অন্যান্য যন্ত্রতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সবই অক্সিজেনের ওপর নির্ভরশীল। টাটকা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ, সুনিদ্রা ও বিশ্রাম, প্রতিদিন শরীরচর্চা—এসবই স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর প্রভাব ফেলে তখনই, যখন আমাদের শ্বাসক্রিয়া চলে অবিরাম। শ্বাস তো জীবনের ভিত্তি।
ভেলর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিজেনের ঘাটতি হলো হূদেরাগ, স্ট্রোক ও ক্যানসারের প্রধান কারণ। সহজ-সরল গভীর শ্বাস গ্রহণ-বর্জনকার্য প্রতিদিন, সেই সঙ্গে মাঝারি মানের শরীরচর্চা খণ্ডন করতে পারে এসব জীবনযাপনে ত্রুটিজনিত রোগগুলোকে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা: অন্যান্য দেহযন্ত্রের তুলনায় মগজের চাই বেশি অক্সিজেন। মগজ পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেলে মনমানস হয় শ্লথগতি, নেতিবাচক চিন্তা ভিড় করে মনে, পর্যায়ক্রমে দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি ক্ষীণতর হতে থাকে।
দেহের সুরক্ষা: প্রতিদিন তাই পাঁচ মিনিট সময় রাখুন গভীর শ্বাসক্রিয়ার জন্য। সহজভাবে বলা যায়, চাপের বিরুদ্ধে এটি হলো দেহের শ্রেষ্ঠ প্রতিরোধব্যবস্থা। প্রবল চাপের মধ্যে থাকলেও কখন শ্বাসক্রিয়া চলছে দ্রুত ও অগভীর, তা অবহিত হওয়া চর্চার মাধ্যমে শেখা যায়। আর তখনই অবিলম্বে শুরু করা যায় দীর্ঘ, গভীর শ্বাস নেওয়া; শরীর তখন ভ্রম হলেও বুঝে নেয় যে চাপ চলে গেছে শরীর-মন থেকে।
কী করে শ্বাস নেবেন বেশি বেশি, প্রতিদিন: দিনের কয়েক মিনিট করুন গভীর শ্বাসক্রিয়া। দ্বিতীয়, যখনই চাপ বোধ করবেন শরীর-মনে, সহজ ও গভীর শ্বাস নিন কয়েকবার। শরীর তখন তাই-ই চায়।
পর পর পাঁচ-দশটি শ্বাস নিন নাসাপথে। এরপর বের করে দিন মুখ দিয়ে, শরীরের প্রাণরসায়নে পড়ে এর প্রভাব, মন করে শান্ত, প্রশান্ত, শিথিল।
শরীরকে আরও সক্রিয়ভাবে শ্বাসকার্যের সঙ্গে যুক্ত করা যায়: দিনের পাঁচ মিনিট গভীর শ্বাসক্রিয়ার জন্য ব্যয় করুন। এমনকি কাজের মাঝে, চাপের মধ্যেও গভীর শ্বাসক্রিয়ার চর্চা করা ভালো। প্রয়োজনে নীরব, শান্ত কোনো স্থানে পালিয়ে গিয়ে, চোখ বুজে শ্বাসক্রিয়া করা তো যায়। আবার কম্পিউটারে কাজও করেছেন, গভীর শ্বাসক্রিয়াও চালাচ্ছেন। যেভাবে হোক, সুফল পাওয়া যাবে। পর পর পাঁচ-দশটি শ্বাস নিন নাসাপথে; এরপর এ রকম চলুক পাঁচ মিনিট, প্রতিদিন। ইফেল ও স্ট্রেচিংয়ের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে শ্বাসক্রিয়া। হাঁটার সময় শ্বাসক্রিয়ার চর্চা করতে পারেন। গভীর শ্বাসক্রিয়া এভাবে হয়ে যাবে জীবনযাপনের অংশ।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২২, ২০১২
Narayan adhikary
ভালো লাগলো। মনে হচ্ছে প্রাণায়াম সম্পর্কে বলা হল। যাহোক আজ থেকে চর্চা করার চেষ্টা করব।